জগতের আত্মা কি আপনাকে বিষাক্ত করছে?
কাজাকিস্তান কারখানায় ১৯৯০ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর এক বিস্ফোরণ হয়েছিল। বিপদজনক তেজস্ক্রিয় পদার্থ আবহাওয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল যা ১,২০,০০০ জন স্থানীয় অধিবাসীর স্বাস্থ্যকে বিপদগ্রস্ত করেছিল যাদের অনেকেই এই মৃত্যুজনক বিষের বিরুদ্ধে পথে প্রকাশ্য প্রতিরোধ প্রদর্শন করেছিল।
কিন্তু আরও তথ্য প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে তারা জানতে পেরেছিল যে তারা বেশ কিছু দশক ধরে এক বিষাক্ত আবহাওয়ার মধ্যে বাস করে এসেছে। বছরের পর বছর ধরে ১,০০,০০০ টন তেজস্ক্রিয় বর্জপদার্থ সুরক্ষাহীনভাবে খোলা জায়গায় ফেলা হয়েছে। যদিও বিপদ একেবারে তাদের দরজায় উপস্থিত ছিল, কেউই এটিকে গুরুত্ব দেয়নি। কেন দেয়নি?
প্রত্যেক দিন স্থানীয় খেলার মাঠে আধিকারিকেরা এক তেজস্ক্রিয় পদার্থ পরিমাপক স্তম্ভ স্থাপন করেছিলেন যেটি এই ধারণা দিত যে কোনরকম বিপদের আশঙ্কা নেই। সংখ্যাগুলি সঠিক ছিল কিন্তু সেগুলি কেবলমাত্র গামা রশ্মিকে সূচিত করত। আলফা রশ্মি যেটি পরিমাপ করা হয়নি সেটিও ততটাই প্রাণনাশক হতে পারে। অনেক মায়েরা উপলব্ধি করতে শুরু করেন যে কেন তাদের সন্তানেরা এত অসুস্থ।
আধ্যাত্মিকভাবে বলতে গেলে আমরাও এক অদৃশ্য দূষিত অবস্থা দ্বারা বিষাক্ত হতে পারি। আর কাজাকিস্তানের সেই হতভাগ্য লোকেদের মত অধিকাংশই এই জীবন বিপন্নকারী আকস্মিক বিপদ সম্পর্কে সচেতন নয়। বাইবেল এই দূষণকে ‘জগতের আত্মা’ হিসাবে শনাক্ত করে, যার নিয়ন্ত্রক শয়তান দিয়াবল ছাড়া আর কেউ নয়। (১ করিন্থীয় ২:১২) ঈশ্বরের বিপক্ষ, আমাদের ঈশ্বরীয় ভক্তি ধ্বংস করার জন্য বিদ্বেষপূর্ণভাবে এই আত্মা—অথবা জগতের প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন মনোভাবকে ব্যবহার করে থাকে।
কিভাবে জগতের আত্মা আমাদের আধ্যাত্মিক শক্তিকে নিঃশেষ করে দিতে পারে? চক্ষুর অভিলাষকে উত্তেজিত করে এবং আমাদের সহজাত স্বার্থপর প্রবণতাকে ব্যবহার করে। (ইফিষীয় ২:১-৩; ১ যোহন ২:১৬) উদাহরণের মাধ্যমে আমরা তিনটি পৃথক পৃথক ক্ষেত্র বিবেচনা করব যেখানে জাগতিক চিন্তাধারা আমাদের আধ্যাত্মিকতাকে ক্রমশ বিষাক্ত করতে পারে।
প্রথমে রাজ্যের অন্বেষণ করা
যীশু খ্রীষ্টানদের উপদেশ দিয়েছিলেন, “প্রথমে তাঁহার রাজ্য ও তাঁহার ধার্ম্মিকতার বিষয়ে চেষ্টা কর।” (মথি ৬:৩৩) অপরপক্ষে জগতের আত্মা আমাদের নিজস্ব আগ্রহ ও স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি অসংগত গুরুত্ব দেওয়ার দিকে পরিচালিত করতে পারে। প্রাথমিক বিপদটি আধ্যাত্মিক আগ্রহকে একেবারে পরিত্যাগ করার মধ্যে সুপ্ত নেই কিন্তু সেগুলিকে দ্বিতীয় স্থানে নির্বাসিত করার মধ্যে আছে। আমরা বিপদটিকে উপেক্ষা করতে পারি—যেমন সুরক্ষা সম্বন্ধে এক মিথ্যা ধারণা থাকার কারণে—কাজাকিস্তানের লোকেরা করেছিল। আমাদের বিশ্বস্ত সেবার বছরগুলি আর আধ্যাত্মিক ভাই ও বোনেদের জন্য আমাদের উপলব্ধিবোধ আমাদের এই বিষয়টি চিন্তা করতে পরিচালিত করতে পারে যে আমরা কখনও সত্যের পথকে পরিত্যাগ করতে পারি না। সম্ভবত ইফিষীয় মণ্ডলীর অনেকে এইরকমই অনুভব করেছিল।
প্রায় সা.কা. ৯৬ সালে, যীশু তাদের নিম্নলিখিত পরামর্শটি দিয়েছিলেন: “তোমার বিরুদ্ধে আমার কথা আছে, তুমি আপন প্রথম প্রেম পরিত্যাগ করিয়াছ।” (প্রকাশিত বাক্য ২:৪) এই দীর্ঘ-সেবারত খ্রীষ্টানেরা অনেক কঠিন পরিস্থিতিগুলি সহ্য করেছিলেন। (প্রকাশিত বাক্য ২:২, ৩) তারা বিশ্বস্ত প্রাচীনদের দ্বারা শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন যার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন প্রেরিত পৌল। (প্রেরিত ২০:১৭-২১, ২৭) কিন্তু বছরগুলি অতিক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে যিহোবার প্রতি তাদের প্রেম হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছিল আর তারা তাদের আধ্যাত্মিক গতি হারিয়ে ফেলেছিলেন।—প্রকাশিত বাক্য ২:৫.
সম্ভবত, কিছুজন ইফিষীয় শহরের বাণিজ্যিক মনোবৃত্তি ও সমৃদ্ধি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। দুঃখের বিষয় যে, আজকের সমাজের বস্তুবাদী প্রবণতা অনুরূপভাবে কিছু খ্রীষ্টানদের মনোযোগ হরণ করেছে। এক স্বচ্ছন্দ জীবনধারার জন্য সংকল্পবদ্ধ প্রচেষ্টা অবশ্যম্ভাবীভাবে আমাদের আধ্যাত্মিক লক্ষ্য থেকে সরিয়ে নিয়ে যাবে।—মথি ৬:২৪ পদের সাথে তুলনা করুন।
এই বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করতে গিয়ে যীশু বলেছিলেন: “চক্ষুই শরীরের প্রদীপ; অতএব তোমার চক্ষু যদি সরল হয়, তবে তোমার সমস্ত শরীর দীপ্তিময় হইবে। কিন্তু তোমার চক্ষু যদি মন্দ [“হিংসাপরায়ণ,” পাদটীকা, NW] হয়, তবে তোমার সমস্ত শরীর অন্ধকারময় হইবে।” (মথি ৬:২২, ২৩) একটি “সরল” চক্ষু এমন একটি চোখ যেটি আধ্যাত্মিকতার প্রতি কেন্দ্রীভূত, একটি চোখ যার দৃষ্টি ঈশ্বরের রাজ্যের প্রতি নিবদ্ধ। অপরপক্ষে, একটি “মন্দ” অথবা “হিংসাপরায়ণ” চক্ষু যেটি দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নয়, কেবলমাত্র তাৎক্ষণিক মাংসিক আকাঙ্ক্ষার প্রতি কেন্দ্রীভূত। আধ্যাত্মিক লক্ষ্য ও ভবিষ্যৎ পুরস্কারগুলি এর সীমার বাইরের বিষয়।
পূর্ববর্তী পদে যীশু বলেছিলেন: “যেখানে তোমার ধন, সেইখানে তোমার মনও থাকিবে।” (মথি ৬:২১) আমরা কিভাবে জানতে পারব যে আমাদের হৃদয় আধ্যাত্মিক অথবা বস্তুগত বিষয়গুলির প্রতি নিবদ্ধ? সম্ভবত আমাদের সর্বোত্তম পরিচালক হল আমাদের কথোপকথন যেহেতু ‘হৃদয়ের উপচয় হইতে মুখ কথা কহে।’ (লূক ৬:৪৫) যদি আমরা দেখি যে আমরা ক্রমাগতভাবে বস্তুগত বিষয় অথবা জাগতিক কীর্তিগুলি সম্বন্ধে কথা বলে চলেছি, তাহলে এটি স্পষ্ট যে আমাদের হৃদয় বিভক্ত ও আমাদের আধ্যাত্মিক দৃষ্টি ত্রুটিযুক্ত।
এক স্পেনীয় বোন কারমেন তার সমস্যাগুলির সাথে প্রবল সংগ্রাম করেছিলেন।a কারমেন ব্যাখ্যা করেন, ‘আমি সত্যে প্রতিপালিত হয়েছিলাম কিন্তু ১৮ বছর বয়সে আমি আমার নিজস্ব শিশু বিদ্যালয় পরিচালনা শুরু করি। তিন বছর পরে আমি চারজন কর্মীকে নিযুক্ত করি, বিদ্যালয়টি সমৃদ্ধি লাভ করে আর আমি প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে থাকি। সম্ভবত যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি পরিতৃপ্ত করেছিল তা ছিল এই সত্যটি যে আমি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা উপভোগ করেছিলাম ও আমি ‘সফল’ ছিলাম। সত্যি কথা বলতে গেলে আমার হৃদয় আমার ব্যবসার প্রতি ছিল—এটিই ছিল আমার সবচেয়ে বড় প্রেম।
“আমি ভেবেছিলাম যে বিদ্যালয়ের পিছনে অধিকাংশ সময় উৎসর্গ করা সত্ত্বেও আমি একজন সাক্ষী থাকতে পারব। অপরদিকে, আমার মনে দোষারোপকারী এই অনুভূতিটিও ছিল যে যিহোবার সেবায় আমি আরও বেশি করতে পারতাম। পরিশেষে যে বিষয়টি রাজ্যের আগ্রহকে প্রথম স্থানে রাখতে আমাকে প্ররোচিত করেছিল তা হল আমার দুই অগ্রগামী বন্ধুর উদাহরণ। তাদের একজন জুলিয়ানা ছিল আমার মণ্ডলীতে। সে অগ্রগামীর কাজ করার জন্য আমাকে জোর করেনি কিন্তু তার কথাবার্তা ও পরিচর্যা থেকে যে আনন্দ সে আহরণ করত তা আমাকে আমার নিজস্ব আধ্যাত্মিক মূল্যকে পুনর্বিবেচনা করতে সাহায্য করেছিল।
“কিছু সময় পরে যুক্তরাষ্ট্রে ছুটির সময় আমি গ্লোরিয়া নামে এক অগ্রগামী বোনের সাথে থেকেছিলাম। তিনি সম্প্রতি বিধবা হয়েছিলেন আর তিনি তার পাঁচ বছরের মেয়ে ও ক্যানসার রোগগ্রস্ত মাকে দেখাশোনা করতেন। তবুও তিনি অগ্রগামীর কাজ করছিলেন। তার উদাহরণ ও পরিচর্যার প্রতি তার আন্তরিক উপলব্ধিবোধ আমার হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল। তার ঘরে তার সাথে সংক্ষিপ্ত চারটি দিন কাটানো আমাকে যিহোবাকে আমার সর্বোত্তমটি দিতে সংকল্পবদ্ধ করেছিল। প্রথমে আমি একজন নিয়মিত অগ্রগামী হয়েছিলাম এবং তার কিছু বছর পরে আমি ও আমার স্বামী বেথেল সেবার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। আমি আমার ব্যবসাকে—আমার আধ্যাত্মিক অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধককে বিদায় জানিয়েছিলাম—আর এখন আমি মনে করি যে আমার জীবন যিহোবার দৃষ্টিতে সার্থক যেটি প্রকৃতই গুরুত্বপূর্ণ।”—লূক ১৪:৩৩.
এইভাবে “বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি সম্পর্কে নিশ্চিত” হতে শেখা যেমন কারমেন করেছিলেন আমাদের চাকুরি, শিক্ষা, গৃহ এবং জীবনধারা সম্পর্কে বিজ্ঞ সিদ্ধান্ত নিতে আমাদেরও সাহায্য করবে। (ফিলিপীয় ১:১০, NW) কিন্তু যখন আমোদপ্রমোদের বিষয়টি আসে তখনও কি আমরা যেগুলি বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সেগুলি পরীক্ষা করে চিনতে পারি? এটি হচ্ছে আর একটি ক্ষেত্র যেখানে জগতের আত্মা তার দুর্দমনীয় প্রভাব প্রয়োগ করতে সচেষ্ট।
অবসর বিনোদনকে তার উপযুক্ত স্থানে রাখুন
জগতের আত্মা চতুরতার সাথে লোকেদের বিশ্রাম ও অবসর বিনোদনের স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষার সুযোগ নিয়ে থাকে। যেহেতু অধিকাংশ লোকেদের ভবিষ্যতের জন্য কোন প্রকৃত আশা নেই, তাই এটি বোধগম্য যে তারা এই বর্তমান সময়টিই আমোদপ্রমোদ ও চিত্তবিনোদন দ্বারা পূর্ণ করার জন্য চেষ্টা করবে। (যিশাইয় ২২:১৩ পদের সাথে তুলনা করুন। ১ করিন্থীয় ১৫:৩২.) আমরা কি নিজেদেরকে অবসর বিনোদনের প্রতি আরও বেশি করে গুরুত্ব দিতে দেখছি? সেটি একটি চিহ্ন যে জগতের চিন্তা পদ্ধতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আকৃতি দিচ্ছে।
বাইবেল সতর্ক করে: “যে আমোদ [“চিত্তবিনোদন,” লামসা] ভালবাসে, তাহার দৈন্যদশা ঘটিবে।” (হিতোপদেশ ২১:১৭) মজা করা অন্যায় নয় কিন্তু এটিকে প্রেম করা অথবা এটিকে মুখ্য গুরুত্বে স্থাপন করা আধ্যাত্মিক দারিদ্রে পরিচালিত করবে। আমাদের আধ্যাত্মিক পুষ্টি অবশ্যম্ভাবীভাবে নিষ্প্রভ হয়ে পড়বে আর সুসমাচার প্রচারের জন্য আমরা খুব অল্প সময়ই পাব।
এই কারণে ঈশ্বরের বাক্য আমাদের উপদেশ দেয় যে “কাজ করার জন্য মনকে জাগিয়ে তোল, সম্পূর্ণভাবে আত্ম-সংযমী হও।” (১ পিতর ১:১৩, দ্যা নিউ ইংলিশ বাইবেল) আমাদের অবসর বিনোদনকে যুক্তিপূর্ণভাবে সীমাবদ্ধ রাখতে আত্মসংযম প্রয়োজনীয়। কাজ করার জন্য জেগে ওঠার অর্থ আধ্যাত্মিক কাজের জন্য তৈরি থাকা তা সেটি অধ্যয়ন, সভাগুলি অথবা ক্ষেত্র পরিচর্যা যাই হোক না কেন।
প্রয়োজনীয় বিশ্রাম সম্বন্ধে কী বলা যায়? যখন আমরা চিত্তবিনোদনের জন্য সময় ব্যয় করি তখন কি আমাদের নিজেদের দোষী অনুভব করা উচিত? কখনই নয়। বিশ্রাম নেওয়া জরুরী বিশেষ করে আজকের চাপপূর্ণ জগতে। তৎসত্ত্বেও, উৎসর্গীকৃত খ্রীষ্টান হিসাবে আমরা আমাদের জীবনকে অবসর বিনোদনের কেন্দ্রস্থলে পরিণত করতে অনুমতি দিতে পারি না। অতিরিক্ত অবসর বিনোদন আমাদের আরও আরও কম অর্থপূর্ণ কাজের প্রতি পরিচালিত করতে পারে। এটি আমাদের তৎপরতার মনোভাবকে হ্রাস করতে পারে আর এটি হয়ত এমনকি আত্ম-তুষ্টিকে উৎসাহিত করতে পারে। তাহলে, বিশ্রামের প্রতি কিভাবে আমরা এক ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে পারি?
বাইবেল সুপারিশ করে যে, শান্তিসহ পূর্ণ এক মুষ্টি—অতিরিক্ত পরিশ্রমের চেয়ে ভাল—বিশেষ করে সেই জাগতিক কাজ যদি অপ্রয়োজনীয় হয়। (উপদেশক ৪:৬) যদিও বিশ্রাম আমাদের শরীরকে পুনরায় শক্তি অর্জন করতে সাহায্য করে, আধ্যাত্মিক শক্তির উৎস হল ঈশ্বরের কার্যকারী শক্তি। (যিশাইয় ৪০:২৯-৩১) আমরা আমাদের খ্রীষ্টীয় কার্যকলাপের সাথে সংযুক্ত এই পবিত্র আত্মা পেয়ে থাকি। ব্যক্তিগত অধ্যয়ন আমাদের হৃদয়কে খাদ্য যোগায় ও সঠিক আকাঙ্ক্ষাকে উদ্দীপিত করে। সভাগুলিতে উপস্থিত হওয়া সৃষ্টিকর্তার প্রতি আমাদের উপলব্ধিবোধকে প্রতিপালন করে। খ্রীষ্টীয় পরিচর্যায় অংশগ্রহণ করা অন্যদের জন্য অনুভূতিকে লালনপালন করে। (১ করিন্থীয় ৯:২২, ২৩) যেমন পৌল বাস্তবভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন, “বাস্তবিক বাহ্যিক মনুষ্য যদিও ক্ষয়প্রাপ্ত ও দুঃখিত হয়, তথাপি আন্তরিক মনুষ্য দিন দিন সতেজতা লাভ করে থাকে।”—২ করিন্থীয় ৪:১৬, ফিলিপস।
ইলিয়ানা ছয়টি সন্তানের মা ও এক অবিশ্বাসী স্বামীর স্ত্রী খুব ব্যস্ত জীবন যাপন করেন। তার নিজের পরিবার ও বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনদের প্রতি তার দায়িত্ব আছে যার অর্থ সর্বদা সবকাজেই তাকে ব্যস্ততা ও তাড়াহুড়োর মধ্যে থাকতে হয়। তৎসত্ত্বেও, প্রচার ও সভাগুলির জন্য প্রস্তুতির ক্ষেত্রে তিনি এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ স্থাপন করেন। কিভাবে তিনি এত বেশি কাজ সামলাতে পারেন?
ইলিয়ানা ব্যাখ্যা করেন ‘সভাগুলি ও ক্ষেত্র পরিচর্যা প্রকৃতই আমার অন্যান্য দায়িত্বগুলির সাথে মোকাবিলা করতে আমাকে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ প্রচারের পর, যখন আমি ঘরের কাজগুলি করি তখন চিন্তা করার জন্য আমার প্রচুর বিষয় থাকে। প্রায়ই আমি এটি করার সময় গান গাই। অপরপক্ষে, যদি আমি একটি সভায় অনুপস্থিত থাকি বা ক্ষেত্র পরিচর্যায় অল্প সময় ব্যয় করি তখন ঘরের কাজগুলি প্রকৃতই এক বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।’
অবসর বিনোদনের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়ার চেয়ে কতই না বিপরীত!
আধ্যাত্মিক সৌন্দর্য যিহোবাকে সন্তুষ্ট করে
আমরা এমন এক জগতে বাস করি যা শারীরিক রূপের প্রতি বর্ধিতহারে আচ্ছন্ন। লোকেরা তাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও বয়সের প্রভাব কম করার জন্য পরিকল্পিত চিকিৎসার পিছনে বিশাল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে থাকে। এটি চুল রোপণ ও রঙ করা, স্তন স্থাপন এবং প্রসাধন শল্যচিকিৎসাকে অন্তর্ভুক্ত করে। কোটি কোটি ব্যক্তিরা ওজন কমানোর কেন্দ্র, শরীরচর্চার স্থান এবং বায়ুজীবী শ্রেণীগুলিতে যোগদান করে অথবা তারা ব্যায়াম শিক্ষার ভিডিওগুলি ও খাদ্যবিধি সংক্রান্ত বইগুলি ক্রয় করে। এই জগৎ আমাদের এটি বিশ্বাস করাতে চায় যে সুখের চাবিটি হচ্ছে আমাদের শারীরিক রূপ, আমাদের “প্রতিচ্ছবি” হচ্ছে সবকিছু।
যুক্তরাষ্ট্রে নিউজউইক পত্রিকার জন্য কৃত এক সমীক্ষা দেখায় যে আমেরিকার ৯০ শতাংশ শ্বেতবর্ণ কিশোর কিশোরীরা “তাদের শারীরিক রূপে অসন্তুষ্ট” ছিল। এক আদর্শ আকৃতির অধিকারী হওয়ার জন্য দুর্দান্ত প্রচেষ্টা আমাদের আধ্যাত্মিকতাকে প্রভাবিত করতে পারে। ডোরা নামে এক যুবতী যিহোবার সাক্ষী তার শারীরিক রূপের জন্য লজ্জা পেত কারণ তার ওজন বেশি ছিল। সে ব্যাখ্যা করে, ‘যখন আমি কেনাকাটা করতাম তখন আমার মাপের কাপড় পাওয়া মুশকিল হত। আদবকায়দা-দোরস্ত পোশাকগুলি যেন কেবল কৃশ কিশোর কিশোরীদের জন্যই তৈরি হত। এর চেয়েও খারাপ হল লোকেরা আমার ওজনের বিষয়ে অসম্মানজনক মন্তব্য করত যা আমাকে ভীষণভাবে বিপর্যস্ত করত, বিশেষ করে যখন এগুলি আমার আধ্যাত্মিক ভাই ও বোনেদের কাছ থেকে আসত।
“এর পরিণামস্বরূপ আমি আরও বেশি করে আমার রূপের প্রতি আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম আর তা এতখানিই ছিল যে আধ্যাত্মিক মূল্য আমার জীবনে দ্বিতীয় স্থান নিতে আরম্ভ করেছিল। এটি এমন ছিল যে আমার আনন্দ যেন আমার কোমরের আকারের উপর নির্ভর ছিল। অনেক বছর কেটে গেছে আর এখন আমি এক নারী ও খ্রীষ্টান হিসাবে পরিপক্ব, এখন আমি বিষয়গুলিকে পৃথকভাবে দেখি। যদিও আমি আমার রূপের বিষয়ে যত্ন নিই, আমি উপলব্ধি করি যে এটি আধ্যাত্মিক সৌন্দর্য যা আরও বড় বিষয় আর এটিই আমাকে সর্বাপেক্ষা বেশি পরিতৃপ্তি দিয়ে থাকে। একসময় যখন আমি সেটি বুঝেছিলাম আমি রাজ্যের আগ্রহকে তার যথাযোগ্য স্থান দিয়েছিলাম।”
প্রাচীনকালের সারা ছিলেন এক বিশ্বস্ত নারী যার এই ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। যদিও বাইবেল তার শারীরিক সৌন্দর্য সম্বন্ধে বলে যখন তিনি ৬০ বছরের বেশি বয়স্কা ছিলেন, এটি মুখ্যত তার উত্তম গুণাবলি—অর্থাৎ হৃদয়ের গুপ্ত মনুষ্যের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করে। (আদিপুস্তক ১২:১১; ১ পিতর ৩:৪-৬) তিনি এক শান্ত ও নম্র মনোভাব প্রদর্শন করেছিলেন আর তিনি তার স্বামীর বাধ্য ছিলেন। সারা এই বিষয়ে অযথার্থভাবে উদ্বিগ্ন ছিলেন না যে অন্যেরা তাকে কোন দৃষ্টিতে দেখে। যদিও তিনি এক সম্পদশালী পটভূমি থেকে এসেছিলেন, তিনি স্বেচ্ছায় ৬০ বছরেরও বেশি সময় তাঁবুতে কাটিয়েছিলেন। তিনি নম্র ও নিঃস্বার্থপরভাবে তার স্বামীকে সমর্থন করেছিলেন; তিনি এক বিশ্বস্ত নারী ছিলেন। সেটিই তাকে প্রকৃত এক সুন্দরী নারীতে পরিণত করেছিল।—হিতোপদেশ ৩১:৩০; ইব্রীয় ১১:১১.
খ্রীষ্টান হিসাবে, আমরা আমাদের আধ্যাত্মিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে আগ্রহী, সেই সৌন্দর্য যে যদি সেটি নিয়মিতভাবে গড়ে তোলা হয় তা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ও চিরস্থায়ী হয়। (কলসীয় ১:৯, ১০) আমরা প্রধান দুটি উপায়ে আমাদের আধ্যাত্মিক রূপের যত্ন নিতে পারি।
আমরা যিহোবার চোখে আরও সুন্দর হয়ে উঠি যখন আমরা জীবন রক্ষাকারী পরিচর্যায় অংশগ্রহণ করে থাকি। (যিশাইয় ৫২:৭; ২ করিন্থীয় ৩:১৮–৪:২) এছাড়াও, যতই আমরা খ্রীষ্টীয় গুণাবলি প্রদর্শন করতে শিখি, আমাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। আমাদের জন্য আধ্যাত্মিক সৌন্দর্য বৃদ্ধির প্রচুর সুযোগ রয়েছে যেমন: ‘পরস্পর স্নেহশীল হয়ে; সমাদরে এক জন অন্যকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করে। . . . আত্মায় উত্তপ্ত হয়ে, . . . অতিথি-সেবায় রত হয়ে। . . . যাহারা আনন্দ করে, তাহাদের সহিত আনন্দ করে; যাহারা রোদন করে, তাহাদের সহিত রোদন করে। . . . মন্দের পরিশোধে কাহারও মন্দ না করে; . . . যদি সাধ্য হয়, তোমাদের যত দূর হাত থাকে, মনুষ্যমাত্রের সহিত শান্তিতে থেকে।’ (রোমীয় ১২:১০-১৮) এইধরনের মনোভাব উৎপন্ন করা আমাদের ঈশ্বর ও সহমানব উভয়ের দৃষ্টিতেই আমাদের প্রিয় করে তুলবে আর এটি আমাদের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত পাপপূর্ণ প্রবণতার কারণে কুৎসিত রূপকে হ্রাস করবে।—গালাতীয় ৫:২২, ২৩; ২ পিতর ১:৫-৮.
আমরা জগতের আত্মার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে পারি!
অনেক ধরনের চাতুরীপূর্ণ উপায়ে জগতের বিষাক্ত আত্মা আমাদের বিশ্বস্ততাকে দুর্বল করে দিতে পারে। এটি আমাদের যা আছে তার প্রতি অতৃপ্ত করতে পারে আর আমাদের নিজস্ব প্রয়োজন এবং আগ্রহকে ঈশ্বরের আগে স্থান দেওয়ার জন্য উদ্বিগ্ন করতে পারে। অথবা এটি আমাদের অবসর বিনোদন ও শারীরিক রূপের বিষয়ে অসংগত গুরুত্ব আরোপ করতে প্ররোচিত করে ঈশ্বরের চিন্তাধারার পরিবর্তে মানুষের চিন্তাধারার প্রতি পরিচালিত করতে পারে।—মথি ১৬:২১-২৩ পদের সাথে তুলনা করুন।
আমাদের আধ্যাত্মিকতাকে ধ্বংস করার জন্য শয়তান বদ্ধপরিকর আর জগতের আত্মা হল তার একটি প্রধান অস্ত্র। স্মরণে রাখুন যে দিয়াবল তার কৌশলগুলিকে এক গর্জনকারী সিংহের পদ্ধতি থেকে এক চতুর সর্পের পদ্ধতিতে পরিবর্তিত করতে পারে। (আদিপুস্তক ৩:১; ১ পিতর ৫:৮) মাঝে মাঝে, নৃশংস তাড়নার দ্বারা জগৎ খ্রীষ্টানদের জয় করে কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি তাকে ধীরে ধীরে বিষাক্ত করে তোলে। পৌল পরবর্তী বিপদ সম্বন্ধে আরও বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন: “আশঙ্কা হইতেছে, পাছে সর্প যেমন আপন ধূর্ত্ততায় হবাকে প্রতারণা করিয়াছিল, তেমনি তোমাদের মন খ্রীষ্টের প্রতি সরলতা ও শুদ্ধতা হইতে ভ্রষ্ট হয়।”—২ করিন্থীয় ১১:৩.
সর্পের ধূর্ত্ততা থেকে নিজেদের সুরক্ষিত করতে আমাদের “জগৎ হইতে হইয়াছে” এমন প্রচারগুলিকে শনাক্ত করা এবং তারপর দৃঢ়ভাবে তা প্রত্যাখ্যান করা প্রয়োজন। (১ যোহন ২:১৬) আমরা অবশ্যই এটি বিশ্বাস করে প্রতারিত হব না যে জাগতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে চিন্তা করা ক্ষতিকারক নয়। শয়তানের ব্যবস্থার বিষাক্ত হাওয়া বিপদাশঙ্কাপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছেছে।—ইফিষীয় ২:২.
একবার জাগতিক চিন্তাধারাকে শনাক্ত করার পর, আমরা আমাদের মন ও হৃদয়কে যিহোবার বিশুদ্ধ শিক্ষার দ্বারা পূর্ণ করার মাধ্যমে এটির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে পারি। রাজা দায়ূদের মত আসুন আমরাও বলি: “সদাপ্রভু, তোমার পথ সকল আমাকে জ্ঞাত কর; তোমার পন্থা সকল আমাকে বুঝাইয়া দেও। তোমার সত্যে আমাকে চালাও, আমাকে শিক্ষা দেও, কেননা তুমিই আমার ত্রাণেশ্বর।”—গীতসংহিতা ২৫:৪, ৫.
[পাদটীকাগুলো]
a বিকল্প নামগুলি ব্যবহার করা হয়েছে।
[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]
এক স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবনধারার জন্য প্রচেষ্টা আমাদের আধ্যাত্মিক লক্ষ্যগুলি থেকে বিচ্যুত করতে পারে