আমাদের আর্কাইভ থেকে
যেভাবে পোর্তুগালে প্রথম ঈশ্বরের রাজ্যের বীজ বপন করা হয়েছিল
একটা জাহাজ আটলান্টিক মহাসাগরের উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে দিয়ে ইউরোপের দিকে যাচ্ছে। জর্জ ইয়াং নামে সেই জাহাজের একজন যাত্রী পরিতৃপ্তির সঙ্গে এই বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করছেন যে, ব্রাজিলে তিনি ঈশ্বরের রাজ্যের জন্য কত কী সম্পাদন করেছেন।a তবে, জাহাজে করে যাওয়ার সময়ে ভাই ইয়াং তার নতুন কার্যভারের দিকে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেন—স্পেন ও পোর্তুগালের সেই এলাকাগুলো, যেগুলোতে বলতে গেলে প্রচার করাই হয়নি। সেখানে পৌঁছে তিনি কয়েকটা বাইবেলভিত্তিক বক্তৃতার আয়োজন করার পরিকল্পনা করছিলেন, যেগুলো ভাই জে. এফ. রাদারফোর্ড তুলে ধরবেন আর সেইসঙ্গে তিনি তিন লক্ষ ট্র্যাক্ট বিতরণ করারও পরিকল্পনা করছিলেন!
ভাই জর্জ ইয়াং সমুদ্র যাত্রা করে অনেক প্রচারের অভিযানে গিয়েছিলেন
১৯২৫ সালের বসন্ত কালে, ভাই ইয়াং লিসবনে পৌঁছে চারিদিকে বিশৃঙ্খলা দেখতে পান। ১৯১০ সালের প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লব রাজতন্ত্রকে উচ্ছেদ করে দিয়েছিল আর এর কারণে ক্যাথলিক গির্জা অনেকটা ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। লোকেরা আরও বেশি স্বাধীনতা লাভ করেছিল ঠিকই কিন্তু দেশের মধ্যে অশান্তি লেগেই ছিল।
ভাই ইয়াং যে-সময়ে ভাই রাদারফোর্ডের বক্তৃতার আয়োজন করেন, ঠিক সেই সময়েই লোকেরা সরকারের ক্ষমতা দখল করতে চেষ্টা করার কারণে সরকার সামরিক আইন চালু করে। ব্রিটিশ আ্যন্ড ফরেন বাইবেল সোসাইটি-র সেক্রেটারি ভাই ইয়াংকে সতর্ক করেন যে, তাকে অনেক বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হবে। তা সত্ত্বেও, ভাই ইয়াং কামইঁশ সেকেন্ডারি স্কুলের ব্যায়ামাগার ব্যবহার করার অনুমতি চেয়ে আবেদন জানান আর তার আবেদন মঞ্জুর করা হয়!
এরপর, মে মাসের ১৩ তারিখ এসে পৌঁছায়—যে-দিনে ভাই রাদারফোর্ডের বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল। সবাই খুব উৎসুক হয়ে ছিল! বিভিন্ন বিল্ডিং ও খবরের কাগজে দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে জনসাধারণের উদ্দেশে সেই বক্তৃতা সম্বন্ধে ঘোষণা করা হয়, যেটার শিরোনাম ছিল “যেভাবে পৃথিবীতে চিরকাল বেঁচে থাকা যায়।” ধর্মীয় বিরোধীরা তাড়াহুড়ো করে তাদের খবরের কাগজে একটা প্রবন্ধ প্রকাশ করে, যাতে তারা সেই খবরের কাগজের পাঠকদের সবেমাত্র আসা “ভাক্ত ভাববাদীদের” বিষয়ে সতর্ক করতে পারে। সেই ব্যায়ামাগারের দরজার সামনে বিরোধীরা হাজার হাজার ব্রোশার বিতরণ করে, যেগুলোতে ভাই রাদারফোর্ডের মাধ্যমে তুলে ধরা শিক্ষাগুলোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হয়েছিল।
এত কিছু সত্ত্বেও, অনেকে সেই বক্তৃতা শুনতে আসে। প্রায় ২,০০০ জন ব্যক্তি সেই ব্যায়ামাগারে ঢুকতে পারে কিন্তু জায়গার অভাবের কারণে আরও ২,০০০-এর মতো ব্যক্তি সেখানে ঢুকতে পারে না। কয়েক জন কৌতূহলী শ্রোতা ব্যায়ামাগারের দেওয়ালে থাকা দড়ির সিঁড়ি থেকে ঝুলে ঝুলে সেই বক্তৃতা শোনে; আবার অন্যেরা ব্যায়ামের সরঞ্জামের উপর চড়ে সেই বক্তৃতা শোনে।
তবে, সব কিছু যে কোনোরকম বিঘ্ন ছাড়াই হয়, এমন নয়। বিরোধীরা চ্যাঁচামেচি করে ও চেয়ার ভাঙচুর করে। কিন্তু ভাই রাদারফোর্ড শান্তভাব বজায় রেখে একটা টেবিলের উপর ওঠেন, যাতে সবাই তার বক্তৃতা শুনতে পারে। প্রায় মাঝরাতে তার বক্তৃতা শেষ হয় আর তখন ১,২০০ জনেরও বেশি আগ্রহী ব্যক্তি তাদের নাম-ঠিকানা লিখে যায়, যাতে তারা বাইবেলভিত্তিক সাহিত্যাদি লাভ করতে পারে। তার পরের দিনই, উ সেকউলু নামে একটা খবরের কাগজে ভাই রাদারফোর্ডের বক্তৃতার বিষয়ে একটা প্রবন্ধ প্রকাশ করা হয়।
১৯২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে, প্রহরীদুর্গ পত্রিকার পোর্তুগিজ ভাষার সংস্করণ পোর্তুগালে প্রকাশিত হতে শুরু করে। (এর আগে, একটা পোর্তুগিজ ভাষার সংস্করণ ইতিমধ্যেই ব্রাজিলে প্রকাশিত হয়েছিল।) প্রায় সেই সময়েই, ভেরঝিলিও ফারগাসান নামে ব্রাজিলের একজন বাইবেল ছাত্র ঈশ্বরের রাজ্যের কাজে সাহায্য করার জন্য পোর্তুগালে চলে আসার পরিকল্পনা করতে শুরু করেন। এর আগে, তিনি ব্রাজিলের বাইবেল ছাত্রদের ছোট্ট শাখা অফিসে ভাই ইয়াংয়ের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। অল্পসময়ের মধ্যেই ভাই ভেরঝিলিও তার স্ত্রী লিজির সঙ্গে ভ্রমণ করেন, যাতে তিনি আবারও ভাই ইয়াংয়ের সঙ্গে মিলিত হতে পারেন। ভাই ফারগাসান ঠিক সময়ে সেখানে এসে পৌঁছান কারণ শীঘ্রই ভাই ইয়াংকে প্রচারের অন্যান্য কার্যভারের এলাকায় চলে যেতে হয়, যেগুলোর মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
বোন লিজি ও ভাই ভেরঝিলিও ফারগাসানের দেশে থাকার অনুমতিপত্র, ১৯২৮ সাল
যখন সামরিকবাহিনী সরকারের ক্ষমতা দখল করে পোর্তুগালে একনায়কতন্ত্র স্থাপন করে, তখন বিরোধিতা আরও বেড়ে যায়। ভাই ফারগাসান সাহস বজায় রাখেন আর বাইবেল ছাত্রদের ছোট্ট দলকে সুরক্ষিত রাখার ও তাদের কাজকে বৃদ্ধি করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। তিনি তার বাড়িতে নিয়মিতভাবে সভার আয়োজন করার জন্য অনুমতি চান আর ১৯২৭ সালের অক্টোবর মাসে, তাকে সেই অনুমতি দেওয়া হয়।
একনায়কতান্ত্রিক শাসনের প্রথম বছরে পোর্তুগালের প্রায় ৪৫০ জন ব্যক্তি প্রহরীদুর্গ পত্রিকার গ্রাহক হওয়ার জন্য আবেদন জানায়। এর পাশাপাশি, ট্র্যাক্ট ও পুস্তিকার মাধ্যমে সত্যের বাক্য পোর্তুগিজ সাম্রাজ্যের দূরদূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে, যেটার মধ্যে ছিল আ্যংগোলা, আ্যজোরেজ, কেপ ভার্ডে, গোয়া, পূর্ব তিমোর, মোজাম্বিক ও ম্যাডিরা।
১৯২০-র দশকের শেষের দিকে ম্যানুয়েল ড্যা সিলভা জোর্ড্যাও নামে একজন নম্র পোর্তুগিজ মালি লিসবনে আসেন। ব্রাজিলে থাকার সময়ে তিনি ভাই ইয়াংয়ের দেওয়া জনসাধারণের উদ্দেশে একটা বক্তৃতা শোনেন। তিনি সঙ্গেসঙ্গে সত্যকে শনাক্ত করেন এবং প্রচার কাজকে বাড়ানোর জন্য ভাই ফারগাসানকে সাহায্য করার বিষয়ে উৎসুক হন। তা করার জন্য ভাই ম্যানুয়েল কলপোর্টার (অগ্রগামী) হিসেবে সেবা করতে শুরু করেন। যেহেতু বাইবেলভিত্তিক সাহিত্যাদি ছাপানোর ও বিতরণ করার কাজ ভালোভাবে শুরু হয়ে যায়, তাই লিসবনে স্থাপিত নতুন মণ্ডলী বৃদ্ধি লাভ করতে থাকে!
১৯৩৪ সালে, ভাই ও বোন ফারগাসানকে ব্রাজিলে ফিরে যেতে হয়। তবে, সত্যের বীজ ইতিমধ্যেই বপন করা হয়ে গিয়েছিল। স্পেনের গৃহযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ইউরোপে ঘটা বিশৃঙ্খলা সত্ত্বেও, পোর্তুগালের বিশ্বস্ত ভাই-বোনেরা দলগতভাবে যিহোবার প্রতি আনুগত্য বজায় রাখে। কিছু সময়ের জন্য তারা জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো হয়ে যায় কিন্তু ১৯৪৭ সালে প্রথম বার গিলিয়েড থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন মিশনারি, ভাই জন কুক সেখানে এসে পৌঁছানোর পর, সেই আগুন আবার দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করে। তারপর, রাজ্যের প্রচারকদের সংখ্যার বৃদ্ধিকে আর থামানো যায়নি। এমনকী ১৯৬২ সালে সরকার যিহোবার সাক্ষিদের কার্যকলাপের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা সত্ত্বেও, প্রকাশকদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। যিহোবার সাক্ষিরা যখন ১৯৭৪ সালে বৈধ স্বীকৃতি লাভ করে, তখন সেই দেশে ১৩,০০০-এর চেয়েও বেশি প্রকাশক ছিল।
বর্তমানে, ৫০,০০০-এর চেয়েও বেশি রাজ্যের প্রকাশক পোর্তুগালে ও সেইসঙ্গে পোর্তুগিজভাষী লোকেদের বিভিন্ন দ্বীপে, যেমন আ্যজোরেজ ও ম্যাডিরাতে ঈশ্বরের রাজ্যের সুসমাচার প্রচার করে থাকে। এই প্রকাশকদের মধ্যে সেই ব্যক্তিদের বংশধরেরাও রয়েছে, যে-ব্যক্তিরা ১৯২৫ সালে ভাই রাদারফোর্ডের সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতা শুনেছিল।
আমরা যিহোবাকে ও সেইসঙ্গে অতীতের সেই বিশ্বস্ত ভাই-বোনদের ধন্যবাদ জানাই, যারা “পরজাতীয়দের নিকটে খ্রীষ্ট যীশুর সেবক” হিসেবে সাহসের সঙ্গে প্রচার কাজে নেতৃত্ব নিয়েছিল।—রোমীয় ১৫:১৫, ১৬.—আমাদের আর্কাইভ থেকে, পোর্তুগাল।
a ২০১৪ সালের ১৫ মে প্রহরীদুর্গ পত্রিকার ৩১-৩২ পৃষ্ঠায় দেওয়া “শস্যচ্ছেদনের কাজ অনেক বাকি আছে” শিরোনামের প্রবন্ধটা দেখুন।