“প্রবৃত্তিগতভাবে বুদ্ধিমান” প্রাণীরা আমাদের কী শেখাতে পারে
শীততাপ নিয়ন্ত্রণ, জল বরফে পরিণত না হতে দেওয়া, সমুদ্রের জল লবণমুক্ত করা এবং জলের তলায় কোন বস্তুর অবস্থান শ্রবণযোগ্য প্রতিধ্বনির দ্বারা শনাক্ত করার প্রযুক্তি হচ্ছে সেই সমস্ত আবিষ্কারগুলি, যা আমাদের বিংশ শতাব্দীর মানুষের কাছে বিস্তৃতভাবে সুপরিচিত। তবুও, প্রাণী জগতে এগুলি সহস্র সহস্র বছর পূর্ব থেকেই অস্তিত্বে ছিল। হ্যাঁ, মানবজাতি এইপ্রকার “প্রবৃত্তিগতভাবে বুদ্ধিমান” (NW) প্রাণীদের বিষয়ে অধ্যয়ন করে উপকৃত হয়। (হিতোপদেশ ৩০:২৪-২৮; ইয়োব ১২:৭-৯) এটি দেখা যায় যে কিছু নির্দিষ্ট প্রাণীরা মানুষের নীরব শিক্ষকে পরিণত হয়েছে আর আমরা তাদের বিষয়ে পরীক্ষা করতে মহাআগ্রহ বোধ করতে পারি।
আমরা কি নির্দিষ্ট কিছু প্রাণীর বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে উপকৃত হতে পারি? হ্যাঁ, যীশু খ্রীষ্ট তাঁর অনুগামীদের মেষ, সর্প, কপোত এবং এমনকি পঙ্গপালের সাথে তুলনা করেছিলেন। তাঁর মনে কোন্ বিষয়টি ছিল যখন তিনি তাঁর অনুগামীদের এই সমস্ত প্রাণীদের সাথে তুলনা করেছিলেন? আসুন আমরা দেখি।
“আমার মেষেরা আমার রব শুনে”
বাইবেলে মেষ কথাটি ২০০ বারেরও বেশি বার উল্লেখিত হয়েছে। স্মিথের বাইবেল ডিক্সনারী যেমন ব্যাখ্যা করে, “মেষ নম্রতা, ধৈর্য্য এবং আনুগত্যের প্রতীকস্বরূপ।” যিশাইয় ৫৩ অধ্যায়ে স্বয়ং যীশুকে ভবিষ্যদ্বাণীমূলকভাবে মেষের সাথে তুলনা করা হয়েছিল। তাই এটি কতই না উপযুক্ত যে তিনি তাঁর অনুগামীদের এই একই প্রাণীর সাথে তুলনা করেছেন! কিন্তু বিশেষভাবে মেষের কোন্ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি যীশুর মনে ছিল?
“আমার মেষেরা আমার রব শুনে, আর আমি তাহাদিগকে জানি, এবং তাহারা আমার পশ্চাদ্গমন করে,” যীশু বলেছিলেন। (যোহন ১০:২৭) এইভাবে তিনি তাঁর শিষ্যদের নম্রতার প্রতি এবং তাঁকে অনুসরণ করার জন্য তাদের ঔৎসুক্যকে আলোকপাত করেছিলেন। আক্ষরিক মেষেরা তাদের পালকের কথা শোনে এবং ইচ্ছুকভাবে তাকে অনুসরণ করে। মেষপালকেরও পালের সাথে এক ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ থাকে।
যখন পশুচারণভূমিতে চড়ে বেড়ায় তখন মেষেরা হয়ত ছড়িয়ে পড়তে পারে, কিন্তু প্রত্যেকটি মেষ সামগ্রিকভাবে দলের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। তাই, যখন এই প্রাণীরা অসুরক্ষিত মনে করে অথবা ভয় পায় “তারা দ্রুত একসাথে জড়ো হয়,” এলেস ফুর ডাস স্কাফ (মেষের সমস্ত বিষয়) নামক বইটি মন্তব্য করে। যদি মেষেরা বিপন্মুক্ত হওয়ার জন্য দৌড়ে পালায়, তাহলে তারা তা করে এক পাল হিসাবে, পরিস্থিতির পূনর্মূল্যায়ন করার জন্য তারা মাঝে মাঝে থামে। “পালানোর এই পর্যায় মেষশাবকদের ও দুর্বল পশুগুলিকে সুরক্ষিত থাকতে সাহায্য দেয়। এই দলবদ্ধ অবস্থা এমনকি তাদের বিশেষ সুরক্ষা দিয়ে থাকে।” আমরা এই ব্যবহার থেকে কী শিখতে পারি?
আজকে সত্য খ্রীষ্টানেরা খ্রীষ্টীয় জগতের মত বিভিন্ন বিভাগে এবং সম্প্রদায়ে বিভক্ত নয়। পরিবর্তে, তারা একটি পালে একত্রিত। প্রত্যেক খ্রীষ্টান ঈশ্বরের এই পালের সাথে তার ব্যক্তিগত সম্বন্ধ অনুভব করে এবং এটি যিহোবার সাক্ষীদের সংগঠনে একতা দান করে। যে কোন সঙ্কটই আসুক না কেন—গুরুতর অসুস্থতা, যুদ্ধ অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ যাই হোক না কেন—প্রত্যেক উপাসক কোথায় পরিচালনা ও সুরক্ষা খোঁজে? যিহোবার সংগঠনে, যা আধ্যত্মিক সুরক্ষা প্রদান করে থাকে।
কিভাবে বাইবেলের পরামর্শ প্রাপ্তিসাধ্য হয়? প্রকাশনাদির মাধ্যমে যেমন প্রহরীদুর্গ এবং এর সাথী পত্রিকা সচেতন থাক! এই পত্রিকাগুলি ও খ্রীষ্টীয় সভাগুলি যাদের অতিরিক্ত যত্নের প্রয়োজন তাদের এমনকি বিশেষ সাহায্য প্রদান করে থাকে ঠিক, পালের মেষশাবক ও দুর্বল মেষেদের মত। উদাহরণস্বরূপ, একক পিতামাতাদের ও যারা হতাশাজনিত কষ্টভোগ করছেন তাদের প্রতি মনোযোগ দেওয়া হয়। তাই এটি কত বিজ্ঞতার কাজ যে, প্রত্যেকটি পত্রিকা পড়া, মণ্ডলীর প্রতিটি সভায় উপস্থিত থাকা এবং আমরা যা শিখছি তা প্রয়োগ করা! তাহলেই আমরা নম্রতা প্রদর্শন করতে পারব ও ঈশ্বরের পালের সাথে এক দৃঢ় সম্বন্ধ রক্ষা করতে পারব।—১ পিতর ৫:২.
“সর্পের ন্যায় সতর্ক ও কপোতের ন্যায় অমায়িক”
স্মিথের বাইবেল ডিক্সনারী মন্তব্য করে: “সমগ্র প্রাচ্যে সর্প অবাধ্যতার আত্মাস্বরূপ মন্দ নীতির প্রতীক হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে।” অপরদিকে, “মম কপোতি!” শব্দটি ছিল ভালোবাসার সম্বোধন। (পরমগীত ৫:২) তাহলে, যীশুর মনে কোন্ বিষয়টি ছিল যখন তিনি তাঁর অনুগামীদের উৎসাহিত করেছিলেন “সর্পের ন্যায় সতর্ক ও কপোতের ন্যায় অমায়িক” হও কথাগুলি বলার দ্বারা?—মথি ১০:১৬.
যীশু প্রচার করা ও শিক্ষা দেওয়ার জন্য নির্দেশাবলী দিচ্ছিলেন। তাঁর শিষ্যেরা এক মিশ্র প্রতিক্রিয়ার আশা করতে পেরেছিলেন। অল্প কিছুজন আগ্রহ দেখিয়েছিল, যেখানে অন্যেরা সুসমাচার প্রত্যাখ্যান করেছিল। কিছু লোকেরা ঈশ্বরের এই সেবকদের এমনকি তাড়নাও করেছিল। (মথি ১০:১৭-২৩) এই তাড়নার প্রতি শিষ্যেরা কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন?
ডাস এফাংগেলিউম ডেস মাটেউস্ (মথি লিখিত সুসমাচার) নামক বইয়ে ফ্রিটস রেনেকার মথি ১০:১৬ পদ সম্বন্ধে বলেন: “চতুরতার . . . সাথে অবশ্যই বিশ্বস্ততা, আন্তরিকতা এবং স্পষ্টতা সংযোজিত হওয়ার প্রয়োজন ছিল, যেন শত্রুদের বৈধ ভিত্তিতে অভিযোগ করার মত কোন কিছু না ঘটে। যীশুর রাজদূতেরা নির্মম বিরোধীদের মধ্যে ছিল যারা কোন বিবেচনা দেখায়নি এবং যারা নিষ্ঠুরভাবে প্রেরিতদের আক্রমণ করেছিল এবং খুব সামান্যতম সুযোগেও। তাই এটি প্রয়োজনীয় ছিল—ঠিক সর্পের ন্যায়—বিরোধীদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা এবং চোখ ও বোধশক্তিকে সতর্ক রেখে পরিস্থিতির পর্যালোচনা করা; ছলনা ও প্রতারণাপূর্ণ না হয়ে পরিস্থিতি আয়ত্তাধীন রাখা, বাক্যে ও কার্যে শুদ্ধ ও সত্য হওয়া আর এইভাবে নিজেদের কপোত সদৃশ প্রমাণ করা।”
মথি ১০:১৬ পদে পাওয়া যীশুর কথাগুলি থেকে ঈশ্বরের আধুনিক-দিনের সেবকেরা কী শিখতে পারে? প্রথম শতাব্দীতে যেমন করেছিল আজকেও লোকেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সুসমাচারের প্রতি একইভাবে প্রতিক্রয়া দেখিয়ে থাকে। যখন তাড়নার সম্মুখীন হয় সত্য খ্রীষ্টানদের সর্পের ন্যায় চতুরতার সাথে কপোতের ন্যায় পবিত্রতা সংযোজিত করা প্রয়োজন। খ্রীষ্টানেরা কখনও প্রতারণা বা অসততা অবলম্বন করে না, কিন্তু অন্যদের কাছে রাজ্যের বার্তা ঘোষণার ক্ষেত্রে তারা নিষ্কলঙ্ক, অন্তরিক এবং সৎ থাকে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়: কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীরা, বিদ্যালয়ে যুবক-যুবতীরা অথবা এমনকি আপনার নিজের পরিবারের সদস্যেরা যিহোবার সাক্ষী হিসাবে আপনার বিশ্বাস সম্বন্ধে তিক্ত মন্তব্য করতে পারে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হয়ত হতে পারে তাদের বিশ্বাস সম্বন্ধে সমভাবে তিরস্কার করে সাড়া দেওয়া। কিন্তু সেটি কি অমায়িক কাজ হবে? কখনই নয়। যদি আপনি আপনার সমালোচককে দেখান যে তাদের মন্তব্য আপনার সুন্দর আচরণে কোন প্রভাব ফেলেনি, তারা হয়ত ভালোর দিকে পরিবর্তন করতে পারে। এইভাবে আপনি চতুর ও নির্দোষ উভয়ই হতে পারবেন—“সর্পের ন্যায় সতর্ক, ও কপোতের ন্যায় অমায়িক।”
“পঙ্গপালের আকৃতি যুদ্ধার্থে সজ্জীভূত অশ্বগণের ন্যায়”
জিইও পত্রিকা রিপোর্ট করে যে ১৭৮৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা, “লিপিবদ্ধ ইতিহাসে নিবন্ধিত সর্ববৃহৎ ঝাঁক [পঙ্গপালের]” দ্বারা বিধ্বস্ত হয়েছিল। এই ঝাঁকটি ৫,২০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা ছেয়ে ফেলেছিল, যা আয়তনে হংকং এর চেয়ে প্রায় পাঁচগুণ ছিল। স্মিথের বাইবেল ডিক্সনারী বলে যে পঙ্গপাল “যে দেশে যায় সেই জায়গার শস্যক্ষেত্রকে তারা মারাত্মকভাবে বিধ্বস্ত করে।”
“প্রভুর দিনে” যা ঘটবে সেই সমস্ত বিষয়ের ঈশ্বর-দত্ত প্রকাশে যীশু পঙ্গপালের একটি ঝাঁক সম্বন্ধীয় এক দর্শন ব্যবহার করেছিলেন। এদের বিষয়ে বলা হয়েছিল: “পঙ্গপালের আকৃতি যুদ্ধার্থে সজ্জীভূত অশ্বগণের ন্যায়।” (প্রকাশিত বাক্য ১:১, ১০; ৯:৩-৭) এই প্রতীকীকরণের তাৎপর্য কী ছিল?
যিহোবার সাক্ষীরা অনেক আগেই বুঝেছিল যে প্রকাশিত বাক্য ৯ অধ্যায়ে বর্ণিত পঙ্গপাল চিত্রিত করে এই শতাব্দীর পৃথিবীতে অবস্থিত ঈশ্বরের অভিষিক্ত সেবকদের।a এই খ্রীষ্টানেরা একটি নির্দিষ্ট কাজে নিযুক্ত রয়েছে—পৃথিবীব্যাপী রাজ্যের বার্তা প্রচার ও শিষ্যকরণের কাজ করা। (মথি ২৪:১৪; ২৮:১৯, ২০) এটি তাদের বাধা অতিক্রম করতে ও তাদের কাজে দৃঢ় থাকতে আবেদন করে। অদম্য পঙ্গপাল ছাড়া কী এই বিষয়টিকে আরও ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারত?
যদিও দৈর্ঘে পাঁচ সেন্টিমিটারের চেয়ে একটু বড়, পঙ্গপাল সাধারণতঃ একদিনে ১০০ থেকে ২০০ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করতে পারে। একধরনের ভ্রমণকারী ধ্বংসাত্মক পঙ্গপাল তা এমনকি ১,০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত প্রসারিত করতে পারে। জিইও পত্রিকা ব্যাখ্যা করে যে “এর পাখায় প্রতি সেকেণ্ডে ১৮ বার কম্পন হয় এবং দিনে ১৭ ঘন্টা পর্যন্ত—অন্য কোন পতঙ্গ যা করতে সক্ষম হয় না।” এইপ্রকার ক্ষুদ্র প্রাণীর জন্য কী প্রকাণ্ড কার্যভার!
একটি দল হিসাবে যিহোবার সাক্ষীরা সুসমাচার ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত। এখন তারা ২৩০টিরও বেশি দেশে প্রচার করে থাকে। ঈশ্বরের এই সেবকেরা এই কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অংশ নেওয়ার জন্য অনেক অসুবিধা অতিক্রম করেছে। কী প্রকার সমস্যাগুলির সম্মুখীন তারা হয়েছে? কুসংস্কার, আইনগত বাধানিষেধ, অসুস্থতা, নিরুৎসাহিতা এবং আত্মীয়দের কাছ থেকে আসা বিরোধিতা হচ্ছে এর মধ্যে অল্প কিছু। কিন্তু কিছুই তাদের অগ্রগতিকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। তারা তাদের ঈশ্বর-দত্ত কার্যভারে দৃঢ়বদ্ধ।
খ্রীষ্টীয় গুণাবলিগুলি ক্রমাগত প্রদর্শন করে চলুন
হ্যাঁ, যীশু তাঁর অনুগামীদের মেষ, সর্প, কপোত এবং পঙ্গপাল প্রভৃতির সাথে তুলনা করেছিলেন। এটি সত্যই আমাদের দিনের জন্য উপযুক্ত। কেন? কারণ এই বিধিব্যবস্থার শেষ আসন্ন এবং সমস্যাগুলিও যে কোন সময়ের তুলনায় আরও বেশি চাপ সৃষ্টিকারী।
যীশুর উদাহরণমূলক বাক্যগুলি মনে রেখে সত্য খ্রীষ্টানেরা ঈশ্বরের পালের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে দৃঢ় থাকে এবং নম্রভাবে যিহোবার সংগঠনের প্রদত্ত পরামর্শ গ্রহণ করে। তারা সেই পরিস্থিতিগুলিকে প্রতিরোধ করে ও সতর্ক থাকে যা তাদের খ্রীষ্টীয় সক্রিয়তাকে প্রতিহত করতে পারে, যেহেতু তারা সর্ববিষয়ে অনিন্দনীয় থাকতে চায়। এছাড়া বাধার সামনেও তারা অধ্যবসায়ের সাথে ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করে। আর তারা ক্রমাগত কিছু “প্রবৃত্তিগতভাবে বুদ্ধিমান” প্রাণীদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে।
[পাদটীকাগুলো]
a ওয়াচটাওয়ার বাইবেল অ্যান্ড ট্র্যাক্ট সোসাইটি দ্বারা প্রকাশিত, প্রকাশিত বাক্য—তার মহান পরিপূর্ণতা সন্নিকট! বইটির ২২ অধ্যায় দেখুন।