অধ্যায় ১৫
যিশু “পৃথিবীতে ন্যায়বিচার স্থাপন করেন”
১, ২. কোন পরিস্থিতিতে যিশু রেগে গিয়েছিলেন এবং কেন?
যিশু রাগ প্রকাশ করেছিলেন—আর তা উপযুক্ত কারণেই। তাঁকে সেভাবে কল্পনা করা আপনার জন্য হয়তো খুবই কঠিন কাজ হবে কারণ তিনি ছিলেন মৃদুশীল ব্যক্তি। (মথি ২১:৫) অবশ্য, নিজের ওপর তাঁর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল কারণ তাঁর রাগ ছিল ন্যায্য।a কিন্তু কী এই শান্তিপ্রিয় ব্যক্তিকে এতটা রাগান্বিত করেছিল? এক জঘন্য অবিচার।
২ যিরূশালেমের মন্দির যিশুর খুবই প্রিয় ছিল। সমস্ত পৃথিবীতে, এটাই ছিল একমাত্র পবিত্র স্থান, যা তাঁর স্বর্গীয় পিতার উপাসনার জন্য উৎসর্গীকৃত ছিল। বহু জায়গা থেকে যিহুদিরা অনেকটা পথ ভ্রমণ করে সেখানে উপাসনা করতে আসত। এমনকি ঈশ্বর-ভয়শীল পরজাতীয়রাও আসত, তাদের ব্যবহারের জন্য মন্দিরের আলাদা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করত। কিন্তু যিশু তাঁর পরিচর্যার প্রথম দিকে মন্দির এলাকায় প্রবেশ করে এক জঘন্য দৃশ্য দেখলেন। সেই জায়গাকে উপাসনার গৃহ নয় বরং বাজারের মতোই মনে হয়েছিল! সেখানে ব্যবসায়ী ও টাকাপয়সার দালালদের ভিড় ছিল। কিন্তু, অবিচার কোথায় ছিল? এদের কাছে ঈশ্বরের মন্দির কেবল লোকেদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার—এমনকি তাদের লুট করার—জায়গা ছিল। কীভাবে?—যোহন ২:১৪.
৩, ৪. যিহোবার গৃহে নিজ স্বার্থসাধনে কোন লোভী কাজ হচ্ছিল এবং তা সংশোধনের জন্য যিশু কোন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন?
৩ ধর্মীয় নেতারা আইন তৈরি করেছিল যে, মন্দিরের কর দেওয়ার জন্য শুধু এক নির্দিষ্ট ধরনের মুদ্রা ব্যবহার করতে হবে। দর্শনার্থীদের এই মুদ্রা পাওয়ার জন্য টাকা ভাঙাতে হতো। তাই, টাকাপয়সা বিনিময়কারীরা তাদের টেবিলগুলো মন্দিরের ভিতরে বসিয়েছিল, প্রতিটা লেনদেনের জন্য পয়সা নিচ্ছিল। পশুপাখি বিক্রি করার ব্যাবসাও খুবই লাভজনক ছিল। দর্শনার্থীরা যারা বলি উৎসর্গ করতে চাইত, তারা শহরের যেকোনো ব্যবসায়ীর কাছ থেকে তা কিনতে পারত কিন্তু মন্দিরের আধিকারিকরা তাদের উৎসর্গকে অযোগ্য বলে সহজেই বাতিল করে দিতে পারত। কিন্তু, মন্দির এলাকা থেকে কেনা বলিগুলো অবশ্যই গ্রহণ করা হতো। এভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন লোকেদের কাছ থেকে ব্যবসায়ীরা মাঝে মাঝে অতিরিক্ত দাম আদায় করত।b এটা কুরুচিপূর্ণ ব্যাবসার চেয়েও খারাপ ছিল। এটা লুট করার সমান ছিল!
“এ স্থান হইতে এ সকল লইয়া যাও”
৪ যিশু এইরকম অবিচার সহ্য করতে পারেননি। এটা তাঁর নিজের পিতার গৃহ ছিল! তিনি দড়ি দিয়ে একটা চাবুক বানিয়ে গবাদি পশু ও মেষের পালকে মন্দির থেকে বের করে দিয়েছিলেন। এরপর তিনি টাকাপয়সা বিনিময়কারীদের কাছে গিয়েছিলেন ও তাদের মেজগুলো উলটে ফেলেছিলেন। কল্পনা করুন যে, সেই সমস্ত মুদ্রা মার্বেল পাথরের মেঝের ওপর ছড়িয়ে পড়েছিল! যে-ব্যক্তিরা ঘুঘু বিক্রি করছিল, তাদের তিনি কড়াভাবে আদেশ দিয়েছিলেন: “এ স্থান হইতে এ সকল লইয়া যাও।” (যোহন ২:১৫, ১৬) কেউই এই সাহসী ব্যক্তির বিরোধিতা করার মতো দুঃসাহস দেখায়নি বলেই মনে হয়।
“পুত্র পিতাকে অনুকরণ করেন”
৫-৭. (ক) কীভাবে যিশুর মনুষ্যপূর্ব অস্তিত্ব তাঁর ন্যায়বিচারের অনুভূতিকে প্রভাবিত করেছিল এবং তাঁর উদাহরণ অধ্যয়ন করে আমরা কী শিখতে পারি? (খ) খ্রিস্ট কীভাবে যিহোবার সার্বভৌমত্ব ও নামের সঙ্গে জড়িত অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন?
৫ ব্যবসায়ীরা আবারও ফিরে এসেছিল। প্রায় তিন বছর পর, যিশু একই অবিচারের মোকাবিলা করেছিলেন, এবারে যারা যিহোবার গৃহকে “দস্যুগণের গহ্বর” করেছিল তাদের নিন্দা করে বলা যিহোবার নিজের বাক্যগুলো উদ্ধৃতি করে। (মথি ২১:১৩; যিরমিয় ৭:১১) হ্যাঁ, যিশু যখন লোকেদেরকে নিজ স্বার্থসাধনে লোভী কাজে ব্যবহার করতে এবং ঈশ্বরের মন্দিরকে কলুষিত হতে দেখেছিলেন, তখন তিনি ঠিক তাঁর পিতার মতোই অনুভব করেছিলেন। আর এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই! কারণ অগণিত লক্ষ লক্ষ বছর ধরে যিশু তাঁর স্বর্গীয় পিতার কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছিলেন। ফলে যিহোবার ন্যায়বিচারের অনুভূতি দ্বারা তিনি পূর্ণ হয়েছিলেন। তাই, আমরা যদি যিহোবার ন্যায়বিচার সম্বন্ধে স্পষ্ট চিত্র পেতে চাই, তা হলে আমাদের জন্য সবচেয়ে ভাল উপায় হল যিশু খ্রিস্টের উদাহরণ নিয়ে ধ্যান করা।—যোহন ১৪:৯, ১০.
৬ যিহোবার একজাত পুত্র সেখানে উপস্থিত ছিলেন যখন শয়তান অন্যায়ভাবে যিহোবা ঈশ্বরকে একজন মিথ্যাবাদী বলেছিল ও তাঁর শাসনের ন্যায্যতা সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলেছিল। কী এক মিথ্যা অপবাদ! শয়তানের পরের প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়েও পুত্র শুনেছিলেন যে, কেউ যিহোবাকে নিঃস্বার্থভাবে, ভালবেসে সেবা করবে না। এই মিথ্যা অভিযোগগুলো নিশ্চয়ই পুত্রের ধার্মিক হৃদয়কে দুঃখিত করেছিল। এটা জেনে নিশ্চতভাবে তিনি কতই না রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন যে, এই মিথ্যাগুলো সংশোধন করায় তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করবেন! (২ করিন্থীয় ১:২০) কীভাবে তিনি তা করবেন?
৭ আমরা যেমন ১৪ অধ্যায়ে দেখেছি যে, যিহোবার সৃষ্ট প্রাণীদের নীতিনিষ্ঠা নিয়ে শয়তান যে-অভিযোগ তুলেছিল, যিশু খ্রিস্ট সেটার চূড়ান্ত, অখণ্ডনীয় উত্তর দিয়েছিলেন। যিশু এভাবে যিহোবার সার্বভৌমত্বের ন্যায্যতা চূড়ান্তভাবে প্রতিপাদন এবং তাঁর নাম পবিত্রীকরণের জন্য ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। যিহোবার সর্বোচ্চ প্রতিনিধি হিসেবে, যিশু বিশ্বের সর্বত্র ঐশিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। (প্রেরিত ৫:৩১) পৃথিবীতে তাঁর জীবনধারা একইভাবে ঐশিক ন্যায়বিচার প্রতিফলিত করেছিল। যিহোবা তাঁর সম্বন্ধে বলেছিলেন: “আমি তাঁহার উপরে আপন আত্মাকে স্থাপন করিব, আর তিনি জাতিগণের কাছে ন্যায়বিচার প্রচার করিবেন।” (মথি ১২:১৮) কীভাবে যিশু এই বাক্যগুলো পরিপূর্ণ করেছিলেন?
যিশু “ন্যায়বিচার” স্পষ্ট করেন
৮-১০. (ক) যিহুদি ধর্মীয় নেতাদের মৌখিক পরম্পরাগত বিধিগুলো কীভাবে ন-যিহুদি ও নারীদের প্রতি অবজ্ঞা গড়ে তুলেছিল? (খ) মৌখিক ব্যবস্থাগুলো যিহোবার বিশ্রামবার সম্বন্ধীয় ব্যবস্থাকে কীভাবে একটা দুর্বহ বোঝাস্বরূপ করেছিল?
৮ যিশু যিহোবার ব্যবস্থা ভালবেসেছিলেন ও সেই অনুযায়ী জীবনযাপন করেছিলেন। কিন্তু, তাঁর দিনের ধর্মীয় নেতারা সেই ব্যবস্থাকে বিকৃত এবং ভুলভাবে প্রয়োগ করেছিল। যিশু তাদের বলেছিলেন: “হা অধ্যাপক ও ফরীশীগণ, কপটীরা, ধিক্ তোমাদিগকে! . . . তোমরা . . . ব্যবস্থার মধ্যে গুরুতর বিষয়—ন্যায়বিচার, দয়া [“করুণা,” NW] ও বিশ্বাস—পরিত্যাগ করিয়াছ।” (মথি ২৩:২৩) কোনো সন্দেহ নেই যে, ঈশ্বরের ব্যবস্থার সেই শিক্ষকগণ “ন্যায়বিচার” স্পষ্ট করেনি। এর পরিবর্তে, ঐশিক ন্যায়বিচারকে তারা দুর্বোধ্য করেছিল। কীভাবে? কয়েকটা উদাহরণ বিবেচনা করুন।
৯ যিহোবা তাঁর লোকেদের তাদের আশেপাশের পৌত্তলিক জাতিগুলো থেকে পৃথক থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। (১ রাজাবলি ১১:১, ২) কিন্তু, কিছু গোঁড়া ধর্মীয় নেতা সমস্ত ন-যিহুদিকে ঘৃণা করতে লোকেদের উৎসাহিত করেছিল। মিশ্না এমনকি এই আইন অন্তর্ভুক্ত করেছিল: “গবাদি পশু পরজাতীয়দের পান্থশালাগুলোতে ফেলে আসা যাবে না কারণ সেগুলোর সঙ্গে তারা যৌনসম্পর্ক করে বলে সন্দেহ করা হয়।” সমস্ত ন-যিহুদির সম্বন্ধে এইরকম প্রতিকূল ধারণা অন্যায় এবং মোশির ব্যবস্থার মূল নীতির একেবারে বিপরীত ছিল। (লেবীয় পুস্তক ১৯:৩৪) মানুষের তৈরি অন্য আইনগুলো নারীদের ছোট করেছিল। মৌখিক আইন বলেছিল যে, একজন স্ত্রীর তার স্বামীর পাশাপাশি নয় কিন্তু পিছনে পিছনে হাঁটা উচিত। একজন পুরুষকে সর্তক করে দেওয়া হয়েছিল যেন সে লোকেদের সামনে কোনো নারীর সঙ্গে, এমনকি তার নিজের স্ত্রীর সঙ্গে কথা না বলে। দাসদের মতো, নারীরাও আদালতে সাক্ষ্য দিতে পারত না। এমনকি একটা প্রচলিত প্রার্থনাও ছিল, যেখানে নারী হিসেবে জন্ম নেয়নি বলে পুরুষেরা ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিত।
১০ ধর্মীয় নেতারা মানুষের তৈরি বিভিন্ন আইন ও নিয়মের স্তূপের তলায় ঈশ্বরের ব্যবস্থাকে চাপা দিয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, বিশ্রামবার সম্বন্ধীয় ব্যবস্থা বিশ্রামবারে কাজ করা নিষেধ করে, সেই দিনটাকে উপাসনা, আধ্যাত্মিক সতেজতা ও বিশ্রামের জন্য আলাদা করেছিল। কিন্তু, ফরীশীরা সেই আইনকে একটা দুর্বহ বোঝাস্বরূপ করেছিল। “কাজ” বলতে কী বোঝাতো, তা তারা নিজেরা নির্ধারণ করেছিল। তারা ৩৯টা বিভিন্ন সক্রিয়তাকে কাজ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল, যেমন ফসল কাটা বা শিকার করা। এই ধরনের শ্রেণীবিভাগ অগণিত প্রশ্নের উত্থাপন করেছিল। একজন পুরুষ যদি বিশ্রামবারে পাখাহীন রক্তপায়ী ছোট কীটকে হত্যা করত, তা হলে সেটা কি শিকার করা ছিল? সে যদি হাঁটার সময় খাওয়ার জন্য এক মুঠো শস্য তুলত, তা হলে সেটা কি শস্য কাটা ছিল? সে যদি অসুস্থ কাউকে সুস্থ করত, তা হলে সে কি কাজ করছিল? এইরকম প্রশ্নগুলো অনমনীয়, পুঙ্খানুপুঙ্খ নিয়মগুলোর প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করিয়েছিল।
১১, ১২. কীভাবে যিশু ফরীশীদের অশাস্ত্রীয় পরম্পরাগত বিধিগুলোর বিরুদ্ধে তাঁর বিরোধিতা প্রকাশ করেছিলেন?
১১ এইরকম এক পরিস্থিতিতে, ন্যায়বিচার কী তা বুঝতে কীভাবে যিশু লোকেদের সাহায্য করেছিলেন? তাঁর শিক্ষাগুলোর মাধ্যমে এবং তিনি যেভাবে জীবনযাপন করেছিলেন, তাতে তিনি ওই ধর্মীয় নেতাদের বিরুদ্ধে এক সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। প্রথমে তাঁর কিছু শিক্ষা বিবেচনা করুন। তিনি মানুষের তৈরি অসংখ্য নিয়মের সরাসরি নিন্দা করেছিলেন, এই কথা বলে: “তোমাদের সমর্পিত পরম্পরাগত বিধি দ্বারা তোমরা ঈশ্বরের বাক্য নিষ্ফল করিতেছ।”—মার্ক ৭:১৩.
১২ যিশু জোরালোভাবে শিক্ষা দিয়েছিলেন যে, বিশ্রামবারের আইন সম্বন্ধে ফরীশীদের ধারণা ভুল ছিল—বাস্তবিকপক্ষে, তারা সেই আইনের পুরো উদ্দেশ্যই ভুল বুঝেছিল। তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, মশীহ হলেন “বিশ্রামবারের কর্ত্তা” আর তাই বিশ্রামবারে লোকেদের সুস্থ করার অধিকার তাঁর রয়েছে। (মথি ১২:৮) এই বিষয়টাকে জোর দেওয়ার জন্য, তিনি বিশ্রামবারে সকলের সামনে অলৌকিকভাবে সুস্থ করেছিলেন। (লূক ৬:৭-১০) এইরকম সুস্থ করার কাজগুলো, তাঁর হাজার বছরের রাজত্বে পৃথিবীব্যাপী তিনি যে-আরোগ্যসাধন করবেন, সেটার এক পূর্বাভাস ছিল। সেই হাজার বছরই সর্বোচ্চ বিশ্রামবার হবে, যখন সমস্ত বিশ্বস্ত মানবজাতি শত শত বছর ধরে পাপ ও মৃত্যুর অধীনে যে-কষ্ট পাচ্ছিল, তা থেকে শেষ পর্যন্ত বিশ্রাম পাবে।
১৩. খ্রিস্টের পার্থিব পরিচর্যার ফলস্বরূপ কোন ব্যবস্থা অস্তিত্বে এসেছিল এবং কীভাবে এটি এর পূর্ববর্তী ব্যবস্থা থেকে আলাদা ছিল?
১৩ এ ছাড়া, ন্যায়বিচার কী তা যিশু এক নতুন ব্যবস্থা অর্থাৎ ‘খ্রীষ্টের ব্যবস্থায়’ স্পষ্ট করেছিলেন, যা তাঁর পার্থিব পরিচর্যা সম্পূর্ণ করার পর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। (গালাতীয় ৬:২) এর পূর্ববর্তী মোশির ব্যবস্থার বৈসাদৃশ্যে, এই নতুন ব্যবস্থা এক ধারাবাহিক লিখিত আজ্ঞাগুলোর ওপর নয় বরং নীতির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করেছিল। তবে, এটা সরাসরি কিছু আজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত করেছিল। এগুলোর একটাকে যিশু “নূতন আজ্ঞা” বলেছিলেন। যিশু তাঁর সমস্ত অনুসারীকে একে অন্যকে ভালবাসতে শিখিয়েছিলেন, ঠিক যেমন তিনি তাদের ভালবেসেছিলেন। (যোহন ১৩:৩৪, ৩৫) হ্যাঁ, যারা “খ্রীষ্টের ব্যবস্থা” অনুযায়ী জীবনযাপন করে, তাদের সকলের জন্য আত্মত্যাগমূলক প্রেম এক শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য ছিল।
ন্যায়বিচারের এক জীবন্ত উদাহরণ
১৪, ১৫. কীভাবে যিশু দেখিয়েছিলেন যে তিনি তাঁর নিজের কর্তৃত্বের সীমা সম্বন্ধে জানতেন এবং কেন তা আশ্বাসদায়ক?
১৪ যিশু প্রেম সম্বন্ধে শিক্ষা দেওয়া ছাড়াও আরও বেশি কিছু করেছিলেন। তিনি “খ্রীষ্টের ব্যবস্থা” অনুযায়ী জীবনযাপন করেছিলেন। এটি তাঁর জীবনধারায় স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছিল। তিনটে উপায় দেখুন, যেখানে যিশুর উদাহরণ ন্যায়বিচার কী তা স্পষ্ট করেছিল।
১৫ প্রথমত, যিশু সতর্কতার সঙ্গে যেকোনো অবিচার করা এড়িয়ে চলেছিলেন। আপনি হয়তো লক্ষ করেছেন যে, অসিদ্ধ মানুষেরা যখন গর্বিত হয়ে পড়ে এবং তাদের কর্তৃত্বের যথাযথ সীমা অতিক্রম করে, তখন বেশির ভাগ অবিচার ঘটে। যিশু তা করেননি। একবার, একজন লোক যিশুর কাছে এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন: “হে গুরু, আমার ভ্রাতাকে বলুন, যেন আমার সহিত পৈতৃক ধন বিভাগ করে।” যিশুর উত্তর কী ছিল? “মনুষ্য, তোমাদের উপরে বিচারকর্ত্তা বা বিভাগকর্ত্তা করিয়া আমাকে কে নিযুক্ত করিয়াছে?” (লূক ১২:১৩, ১৪) এটা কি উল্লেখযোগ্য নয়? যিশুর মেধা, তাঁর বিচার করার ক্ষমতা আর এমনকি তাঁর ঈশ্বরদত্ত কর্তৃত্বের পরিধি পৃথিবীর যেকারও চেয়ে অনেক বেশি ছিল; তবুও, তিনি এই বিষয়ে নিজেকে জড়াননি কারণ তাঁকে তা করার কর্তৃত্ব দেওয়া হয়নি। এভাবে যিশু সবসময় বিনয়ী ছিলেন এমনকি লক্ষ লক্ষ বছর ধরে তাঁর মনুষ্যপূর্ব অস্তিত্বের সময়ও। (যিহূদা ৯) কোনটা ন্যায্য, তা নির্ধারণ করার জন্য যিশু যে নম্রভাবে যিহোবার ওপর নির্ভর করেন, সেটাই তাঁর সম্বন্ধে অনেক কিছু জানায়।
১৬, ১৭. (ক) ঈশ্বরের রাজ্যের সুসমাচার প্রচার করার ক্ষেত্রে কীভাবে যিশু ন্যায়বিচার প্রদর্শন করেছিলেন? (খ) কীভাবে যিশু দেখিয়েছিলেন যে ন্যায়বিচার সম্বন্ধে তাঁর অনুভূতি করুণাপূর্ণ ছিল?
১৬ দ্বিতীয়ত, যিশু যেভাবে ঈশ্বরের রাজ্যের সুসমাচার প্রচার করেছিলেন, তাতে ন্যায়বিচার প্রদর্শন করেছিলেন। তিনি কোনোরকম পক্ষপাতিত্ব দেখাননি। এর পরিবর্তে, তিনি ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সমস্ত ধরনের লোকের কাছে পৌঁছানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। এর বৈসাদৃশ্যে, ফরীশীরা গরিব, সাধারণ লোকেদের অগ্রাহ্য করেছিল এবং তাদের অ্যামহাআরেটস্ বা “ভূমির মানুষ” এই অবজ্ঞাপূর্ণ আখ্যা দিয়েছিল। যিশু সেই অবিচার সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করেছিলেন। তিনি যখন লোকেদের সুসমাচার শিক্ষা দিয়েছিলেন—বা এই উদ্দেশ্যে তিনি যখন লোকেদের সঙ্গে খেয়েছিলেন, তাদের খাইয়েছিলেন, সুস্থ করেছিলেন বা এমনকি পুনরুত্থিত করেছিলেন—তখন তিনি ঈশ্বরের ন্যায়বিচার তুলে ধরেছিলেন, যিনি ‘সমুদয় মনুষ্যের’ কাছে পৌঁছাতে চান।c—১ তীমথিয় ২:৪.
১৭ তৃতীয়ত, ন্যায়বিচার সম্বন্ধে যিশুর অনুভূতি অত্যন্ত করুণাপূর্ণ ছিল। তিনি পাপীদের সাহায্য করার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। (মথি ৯:১১-১৩) তিনি নিজে থেকে সেই লোকেদের সাহায্য করেছিলেন, যাদের নিজেদের রক্ষা করার শক্তি ছিল না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, ধর্মীয় নেতারা সমস্ত পরজাতীয় ব্যক্তির প্রতি যে-সন্দেহ জাগিয়ে তুলছিল, তাতে যিশু তাদের সঙ্গে যোগ দেননি। তিনি করুণার সঙ্গে এদের কয়েক জনকে সাহায্য করেছিলেন ও শিক্ষা দিয়েছিলেন, যদিও তাঁর প্রধান কাজ ছিল যিহুদি লোকেদের সাহায্য করা। তিনি একজন রোমীয় সেনাপতির জন্য অলৌকিকভাবে সুস্থ করার কাজ করতে রাজি হয়েছিলেন, এই কথা বলে: “ইস্রায়েলের মধ্যে কাহারও এত বড় বিশ্বাস দেখিতে পাই নাই।”—মথি ৮:৫-১৩.
১৮, ১৯. (ক) কোন কোন উপায়ে যিশু নারীদের মর্যাদা উন্নীত করেছিলেন? (খ) যিশুর উদাহরণ কীভাবে আমাদের সাহস ও ন্যায়বিচারের মধ্যে সম্পর্ক দেখতে সাহায্য করে?
১৮ একইভাবে, যিশু নারীদের সম্বন্ধে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করেননি। এর পরিবর্তে, তিনি সাহসের সঙ্গে তা-ই করেছিলেন, যা ন্যায্য ছিল। শমরীয় নারীদের পরজাতীয়দের মতোই অশুচি বলে মনে করা হতো। কিন্তু, যিশু শুখর নামক জায়গায় এক কুয়োর ধারে একজন শমরীয় নারীর কাছে প্রচার করতে দ্বিধা করেননি। সত্যি বলতে কী, এই নারীর কাছেই যিশু প্রথমে নিজেকে স্পষ্টভাবে প্রতিজ্ঞাত মশীহ বলে শনাক্ত করেছিলেন। (যোহন ৪:৬, ২৫, ২৬) ফরীশীরা বলত যে, ঈশ্বরের ব্যবস্থা সম্বন্ধে নারীদের শিক্ষা দেওয়া উচিত নয় কিন্তু যিশু নারীদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য অনেক সময় ও শক্তি ব্যয় করেছিলেন। (লূক ১০:৩৮-৪২) আর যেখানে পরম্পরাগত বিধি অনুযায়ী মনে করা হতো যে, নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য দেওয়ার ব্যাপারে নারীদের ওপর নির্ভর করা যায় না, সেখানে যিশু তাঁর পুনরুত্থানের পর কয়েক জন নারীকে তাঁকে প্রথমে দেখার বিশেষ সুযোগ দিয়ে তাদের মর্যাদা দিয়েছিলেন। তিনি এমনকি তাদের বলেছিলেন যে, তারা যেন গিয়ে তাঁর শিষ্যদের, যারা পুরুষ ছিল, তাদের এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সম্বন্ধে বলে!—মথি ২৮:১-১০.
১৯ হ্যাঁ, ন্যায়বিচার কী তা যিশু বিভিন্ন জাতির কাছে স্পষ্ট করেছিলেন। অনেক ক্ষেত্রে, তিনি ব্যক্তিগত প্রচণ্ড ঝুঁকির মধ্যেও তা করেছিলেন। যিশুর উদাহরণ আমাদের দেখতে সাহায্য করে যে, প্রকৃত ন্যায়বিচারকে সমর্থন করার জন্য সাহসের দরকার। উপযুক্তভাবেই, তাঁকে “যিহূদাবংশীয় সিংহ” বলা হয়েছিল। (প্রকাশিত বাক্য ৫:৫) মনে করে দেখুন যে, সিংহ সাহসী ন্যায়বিচারের প্রতীক। তবে, নিকট ভবিষ্যতে যিশু আরও মহৎ ন্যায়বিচার নিয়ে আসবেন। সম্পূর্ণ অর্থে, তিনি “পৃথিবীতে ন্যায়বিচার” স্থাপন করবেন।—যিশাইয় ৪২:৪.
মশীহ রাজা “পৃথিবীতে ন্যায়বিচার স্থাপন করেন”
২০, ২১. আমাদের সময়ে, মশীহ রাজা কীভাবে পৃথিবীর সর্বত্র ও খ্রিস্টীয় মণ্ডলীর মধ্যে ন্যায়বিচার উন্নীত করেছেন?
২০ যিশু ১৯১৪ সালে মশীহ রাজা হওয়ার পর থেকে পৃথিবীতে ন্যায়বিচার উন্নীত করেছেন। কীভাবে? মথি ২৪:১৪ পদে পাওয়া তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী পরিপূর্ণ করার দায়িত্ব তিনি বহন করেছেন। যিশুর অনুসারীরা পৃথিবীর সমস্ত জায়গার লোকেদের যিহোবার রাজ্য সম্বন্ধীয় সত্য শিক্ষা দিয়েছেন। যিশুর মতো, তারা পক্ষপাতহীন ও ন্যায্যভাবে প্রচার করেছেন, প্রত্যেককে—যুবক-বৃদ্ধ, ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষকে—ন্যায়বিচারক ঈশ্বর যিহোবাকে জানার সুযোগ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
২১ এ ছাড়া, যিশু খ্রিস্টীয় মণ্ডলীর মধ্যেও ন্যায়বিচার উন্নীত করছেন, যেটার মস্তক স্বয়ং তিনি। ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, তিনি “মনুষ্যদিগকে নানা বর [“দানরূপ মানুষদের,” NW],” অর্থাৎ বিশ্বস্ত খ্রিস্টান প্রাচীনদের ব্যবস্থা করেন, যারা মণ্ডলীতে নেতৃত্ব দেয়। (ইফিষীয় ৪:৮-১২) ঈশ্বরের মহামূল্যবান পালের যত্ন নেওয়ার সময়, এই ব্যক্তিরা ন্যায়বিচার উন্নীত করার ক্ষেত্রে যিশু খ্রিস্টের উদাহরণ অনুসরণ করে। তারা সবসময় মনে রাখে যে, যিশু চান তাঁর মেষের সঙ্গে ন্যায্য আচরণ করা হোক—তা তার মর্যাদা, খ্যাতি বা বস্তুগত পরিস্থিতি যাই হোক না কেন।
২২. আজকের জগতে দ্রুত বেড়ে চলা অবিচার সম্বন্ধে যিহোবা কেমন বোধ করেন এবং তিনি এই বিষয়ে কী করার জন্য তাঁর পুত্রকে নিযুক্ত করেছেন?
২২ তবে, নিকট ভবিষ্যতে যিশু পৃথিবীতে অভূতপূর্বভাবে ন্যায়বিচার স্থাপন করবেন। এই কলুষিত জগতে অবিচার খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্ষুধায় কষ্ট পেয়ে মারা যাওয়া প্রতিটা শিশু ক্ষমার অযোগ্য অবিচারের শিকার, বিশেষ করে আমরা যখন সেই টাকাপয়সা ও সময়ের কথা চিন্তা করি, যা যুদ্ধাস্ত্র এবং আমোদপ্রিয় লোকেদের স্বার্থপর খেয়ালগুলো মেটানোর জন্য প্রচুর পরিমাণে ব্যয় করা হয়। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ লোকের অকারণে মৃত্যু, বিভিন্ন রকমের অবিচারের মধ্যে শুধু একটা, যেগুলোর সমস্তই যিহোবার ন্যায্য ক্রোধকে জাগিয়ে তোলে। তিনি তাঁর পুত্রকে স্থায়ীভাবে সমস্ত অবিচার দূর করতে এই সম্পূর্ণ দুষ্ট বিধিব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক ন্যায্য যুদ্ধ করার জন্য নিযুক্ত করেছেন।—প্রকাশিত বাক্য ১৬:১৪, ১৬; ১৯:১১-১৫.
২৩. হর্মাগিদোনের পর, খ্রিস্ট অনন্তকাল ধরে কীভাবে ন্যায়বিচার উন্নীত করবেন?
২৩ কিন্তু, যিহোবার ন্যায়বিচার শুধু দুষ্টদের ধ্বংসই চায় না। তিনি তাঁর পুত্রকে “শান্তিরাজ” হিসেবে শাসন করার জন্যও নিযুক্ত করেছেন। হর্মাগিদোনের যুদ্ধের পর, যিশুর শাসন পৃথিবীর সর্বত্র শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে এবং তিনি “ন্যায়বিচারে” শাসন করবেন। (যিশাইয় ৯:৬, ৭) সেই সময় যিশু সমস্ত অবিচার শেষ করে আনন্দিত হবেন, যা এই জগতে এত দুর্দশা ও কষ্ট ঘটিয়েছে। অনন্ত কাল ধরে, তিনি বিশ্বস্তভাবে যিহোবার নিখুঁত ন্যায়বিচার তুলে ধরবেন। তাই, আমাদের এখন যিহোবার ন্যায়বিচার অনুকরণ করার চেষ্টা করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আসুন আমরা দেখি যে, আমরা তা কীভাবে করতে পারি।
a ন্যায্য রাগ প্রকাশে যিশু ছিলেন যিহোবার মতো, যিনি সমস্ত দুষ্টতার বিরুদ্ধে “ক্রোধশালী।” (নহূম ১:২) উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, যিহোবা তাঁর স্বেচ্ছাচারী লোকেদের তারা যে তাঁর গৃহকে “দস্যুগণের গহ্বর” করেছে তা বলার পর, এই কথা বলেছিলেন: “এই স্থানের উপরে, . . . আমার ক্রোধ ও কোপ ঢালা যাইবে।”—যিরমিয় ৭:১১, ২০.
b মিশ্না অনুযায়ী, কয়েক বছর পর মন্দিরে চড়া দামে ঘুঘু বিক্রির বিষয়ে আপত্তি তোলা হয়েছিল। ফলে দাম রাতারাতি শতকরা ৯৯ ভাগ কমে গিয়েছিল! এই লাভজনক ব্যাবসা থেকে মূলত কারা বেশি লাভবান হতো? কয়েক জন ইতিহাসবেত্তা মনে করে যে, মন্দিরের বাজার মহাযাজক হাননের পরিবারের লোকেদের ছিল, যা যাজক পরিবারকে প্রচুর সম্পদের মালিক করেছিল।—যোহন ১৮:১৩.
c যারা ব্যবস্থা খুব ভাল জানত না সেই নিচু শ্রেণীর লোকেদের, ফরীশীরা “শাপগ্রস্ত” বলে মনে করত। (যোহন ৭:৪৯) তারা বলত যে, একজন ব্যক্তির এইরকম লোকেদের শিক্ষা দেওয়া অথবা তাদের সঙ্গে কোনোরকম ব্যবসায়িক লেনদেন বা খাওয়াদাওয়া অথবা প্রার্থনা করা উচিত নয়। একজন ব্যক্তি যদি তার মেয়েকে তাদের একজনের সঙ্গে বিয়ে দিত, তা হলে সেই মেয়েকে বন্যপশুদের সামনে ফেলে দেওয়ার চেয়েও খারাপ বলে মনে করত। তারা মনে করত যে, এইরকম নিচু শ্রেণীর লোকেরা পুনরুত্থানের আশা থেকে বঞ্চিত।