যিহোবা—প্রকৃত ন্যায়বিচার এবং ধার্মিকতার উৎস
“তিনি শৈল, তাঁহার কর্ম্ম সিদ্ধ, কেননা তাঁহার সমস্ত পথ ন্যায্য; তিনি বিশ্বাস্য ঈশ্বর, তাঁহাতে অন্যায় নাই।”—দ্বিতীয় বিবরণ ৩২:৪.
১. কেন আমাদের ন্যায়বিচারের প্রতি এক জন্মগত চাহিদা রয়েছে?
ঠিক যেমন প্রত্যেকের ভালবাসা পাওয়ার জন্য সহজাত চাহিদা থাকে, তদ্রূপ আমরা সকলেই আকুলভাবে চাই যেন আমাদের প্রতি ন্যায্য আচরণ করা হয়। আমেরিকার কূটনীতিক থমাস জেফারসন যেমন লিখেছিলেন, “অনুভূতি, দর্শন অথবা শ্রবণ যতটা আমাদের দৈহিক গঠনের অংশ ঠিক ততটাই . . . [ন্যায়বিচার] স্বাভাবিক এবং সহজাত।” এটি আশ্চর্যের বিষয় নয়, কারণ যিহোবা আমাদের তাঁর নিজ প্রতিমূর্তিতে সৃষ্টি করেছিলেন। (আদিপুস্তক ১:২৬) বাস্তবিক পক্ষে, তিনি আমাদের সেই গুণাবলি দিয়েছিলেন যেগুলি তাঁর নিজস্ব ব্যক্তিত্বকে প্রতিফলিত করে, যার একটি হল ন্যায়বিচার। সেই কারণেই আমাদের ন্যায়বিচারের প্রতি এক জন্মগত চাহিদা রয়েছে এবং আমরা প্রকৃত ন্যায়বিচার ও ধার্মিকতাপূর্ণ এক জগতে বাস করতে আকাঙ্ক্ষী।
২. যিহোবার কাছে ন্যায়বিচার কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐশিক ন্যায়বিচারের অর্থ উপলব্ধি করা আমাদের কেন প্রয়োজন?
২ যিহোবা সম্বন্ধে, বাইবেল আমাদের আশ্বাস দেয়: “তাঁহার সমস্ত পথ ন্যায্য।” (দ্বিতীয় বিবরণ ৩২:৪) কিন্তু অন্যায়ের দ্বারা আক্রান্ত এক জগতে, ঐশিক ন্যায়বিচারের অর্থ উপলব্ধি করা সহজ নয়। যাইহোক, ঈশ্বরের বাক্যের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে কিভাবে ঈশ্বর ন্যায়বিচার সম্পাদন করেন আর এভাবেই আমরা ঈশ্বরের চমৎকার পথগুলিকে আরও বেশি উপলব্ধি করতে পারি। (রোমীয় ১১:৩৩) বাইবেল-ভিত্তিক জ্ঞানে ন্যায়বিচারের অর্থ বোঝা গুরুত্বপূর্ণ কারণ ন্যায়বিচার সম্পর্কে আমাদের ধারণা হয়ত মানুষের মতবাদগুলির দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। একজন মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে, ন্যায়বিচারকে হয়ত আইনগত শাসনের এক পক্ষপাতহীন প্রয়োগের চেয়ে অধিক কিছু বলে বিবেচনা করা হয় না। আর দার্শনিক ফ্রান্সিস ব্যাকন যেমন লিখেছিলেন, “ন্যায়বিচারের অন্তর্ভুক্ত হল প্রত্যেক ব্যক্তির যা প্রাপ্য তাকে তা দেওয়া।” কিন্তু যিহোবার ন্যায়বিচার আরও বেশি কিছুকে অন্তর্ভুক্ত করে।
যিহোবার ন্যায়বিচার হৃদয়গ্রাহী
৩. ন্যায়বিচার ও ধার্মিকতার জন্য বাইবেলে ব্যবহৃত মূল ভাষার শব্দগুলি বিবেচনা করার দ্বারা কী জানা যেতে পারে?
৩ ঈশ্বরের ন্যায়বিচারের ব্যাপকতা, বাইবেলে মূল ভাষায় শব্দগুলি যেভাবে ব্যবহৃত হয়েছে তা বিবেচনা করার দ্বারা আরও ভালভাবে বোঝা যেতে পারে।a এটি আগ্রহজনক যে, শাস্ত্রে ন্যায়বিচার ও ধার্মিকতার মধ্যে কোন তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য নেই। বাস্তবিক পক্ষে, ইব্রীয় শব্দগুলি কোন কোন সময় একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন আমরা আমোষ ৫:২৪ পদে দেখি যেখানে যিহোবা তাঁর লোকেদের পরামর্শ দেন: “বিচার [“ন্যায়বিচার,” “NW”] জলবৎ প্রবাহিত হউক, ধার্ম্মিকতা চিরপ্রবহমাণ স্রোতের ন্যায় বহুক।” অধিকন্তু, ‘ন্যায়বিচার ও ধার্ম্মিকতা’ পরিভাষাগুলি, জোর দেওয়ার জন্য কয়েকবার একত্রে উপস্থাপন করা হয়।—গীতসংহিতা ৩৩:৫; যিশাইয় ৩৩:৫; যিরমিয় ৩৩:১৫; যিহিষ্কেল ১৮:২১; ৪৫:৯.
৪. ন্যায়বিচার অনুশীলন করার অর্থ কী এবং ন্যায়বিচারের চূড়ান্ত মানদণ্ডটি কী?
৪ এই ইব্রীয় ও গ্রীক শব্দগুলির দ্বারা কী অর্থ প্রকাশিত হয়? শাস্ত্রীয় অর্থে ন্যায়বিচার অনুশীলন করার অর্থ যা কিছু সঠিক এবং পক্ষপাতহীন তা করা। যেহেতু যিহোবাই নৈতিক আইন ও নীতিগুলি অথবা যা কিছু সঠিক ও পক্ষপাতহীন তা স্থাপন করেন, তাই যিহোবা যেভাবে বিষয়গুলি সম্পাদন করেন সেটিই হচ্ছে ন্যায়বিচারের চূড়ান্ত মানদণ্ড। পুরাতন নিয়মের ঈশ্বরতত্ত্ববিষয়ক শব্দকোষ (ইংরাজি) ব্যাখ্যা করে যে, ধার্মিকতা (সিধেক্) হিসাবে অনূদিত ইব্রীয় শব্দটি “এক নীতিশাস্ত্রগত, নৈতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং অবশ্যই পু[রাতন] নি[য়মে] ওই মানদণ্ড হল ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্য এবং ইচ্ছা।” অতএব, ঈশ্বর যেভাবে তাঁর নীতিগুলি প্রয়োগ করেন এবং বিশেষ করে যেভাবে তিনি অসিদ্ধ মানুষের সঙ্গে আচরণ করেন, তা প্রকৃত ন্যায়বিচার ও ধার্মিকতার তাৎপর্য প্রকাশ করে।
৫. ঈশ্বরের ন্যায়বিচারের সঙ্গে কোন্ গুণাবলি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত?
৫ শাস্ত্র স্পষ্টভাবে দেখায় যে ঈশ্বরীয় ন্যায়বিচার রূঢ় এবং একরোখা নয় বরং হৃদয়গ্রাহী। দায়ূদ গেয়েছিলেন: “সদাপ্রভু ন্যায়বিচার ভালবাসেন; তিনি আপন সাধুগণকে পরিত্যাগ করেন না।” (গীতসংহিতা ৩৭:২৮) ঈশ্বরের ন্যায়বিচার তাঁকে তার দাসেদের প্রতি বিশ্বস্ততা এবং করুণা দেখাতে পরিচালিত করে। ঐশিক ন্যায়বিচার আমাদের চাহিদাগুলির প্রতি সংবেদনশীল এবং আমাদের অসিদ্ধতার প্রতি বিবেচনা দেখায়। (গীতসংহিতা ১০৩:১৪) তার অর্থ এই নয়, ঈশ্বর দুষ্টতাকে উপেক্ষা করেন, কারণ তা করা অন্যায়কে উৎসাহিত করা হবে। (১ শমূয়েল ৩:১২, ১৩; উপদেশক ৮:১১) যিহোবা মোশির কাছে ব্যাখ্যা করেছিলেন, তিনি “স্নেহশীল ও কৃপাময়, . . . ক্রোধে ধীর এবং দয়াতে ও সত্যে মহান্।” যদিও ঈশ্বর ভুল এবং পাপ ক্ষমা করার জন্য ইচ্ছুক, তথাপি যারা শাস্তি পাওয়ার যোগ্য তাদের তিনি তা থেকে অব্যাহতি দেবেন না।—যাত্রাপুস্তক ৩৪:৬, ৭.
৬. যিহোবা তাঁর পার্থিব সন্তানদের সঙ্গে কিভাবে আচরণ করেন?
৬ যিহোবা যেভাবে ন্যায়বিচার অনুশীলন করেন তা আমরা যখন ধ্যান করি তখন তাঁকে, কেবল অপরাধীকে দণ্ড দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহী একজন অনমনীয় বিচারক হিসাবে আমাদের চিন্তা করা উচিত নয়। বিপরীতে, আমাদের তাঁকে একজন প্রেমময় কিন্তু অবিচলিত পিতা হিসাবে চিন্তা করা উচিত যিনি সর্বদা তাঁর সন্তানদের সঙ্গে সম্ভাব্য সর্বোত্তম উপায়ে আচরণ করে থাকেন। “হে সদাপ্রভু, তুমি আমাদের পিতা,” ভাববাদী যিশাইয় বলেছিলেন। (যিশাইয় ৬৪:৮) একজন ন্যায়পরায়ণ এবং ধার্মিক পিতা হিসাবে, যিহোবা তাঁর পার্থিব সন্তানদের প্রতি স্নেহপূর্ণ করুণা এবং সঠিক বিষয়ের দৃঢ়তার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখেন, যাদের কঠিন পরিস্থিতি এবং মাংসিক দুর্বলতাগুলির কারণে সাহায্য ও ক্ষমার প্রয়োজন রয়েছে।—গীতসংহিতা ১০৩:৬, ১০, ১৩.
ন্যায়বিচার কী তা স্পষ্ট করা
৭. (ক) যিশাইয়ের ভবিষ্যদ্বাণী থেকে ঐশিক ন্যায়বিচার সম্বন্ধে আমরা কী শিখি? (খ) ন্যায়বিচার সম্বন্ধে জাতিগুলিকে শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে যীশুর কোন্ ভূমিকা ছিল?
৭ যিহোবার ন্যায়বিচারের করুণাপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, মশীহের আগমনের দ্বারাও তুলে ধরা হয়েছিল। যীশু ঐশিক ন্যায়বিচার সম্বন্ধে শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং এর সঙ্গে সংগতি রেখে জীবনযাপন করেছিলেন, যেমন ভাববাদী যিশাইয়ের দ্বারা ভাববাণী করা হয়েছিল। স্পষ্টতই, ঈশ্বরের ন্যায়বিচার নিপীড়িত লোকেদের সঙ্গে কোমল আচরণকে অন্তর্ভুক্ত করে। অতএব, তারা ভেঙে পড়েন না বরং উদ্ধার পান। যিহোবার “দাস” যীশু, ঈশ্বরের ন্যায়বিচারের এই দিকটি “জাতিগণের কাছে . . . প্রচার” করার জন্য পৃথিবীতে এসেছিলেন। সর্বোপরি, ঐশিক ন্যায়বিচারের অর্থ কী তার একটি জীবন্ত উদাহরণ আমাদের দেওয়ার দ্বারা তিনি তা করেছিলেন। রাজা দায়ূদের বংশে ‘ধার্মিকতার পল্লব’ হিসাবে, যীশু “বিচারে যত্নবান ও ধার্ম্মিকতা-সাধনে সত্বর” হওয়ার জন্য আকুল আকাঙ্ক্ষী ছিলেন।—যিশাইয় ১৬:৫; ৪২:১-৪; মথি ১২:১৮-২১; যিরমিয় ৩৩:১৪, ১৫.
৮. কেন প্রকৃত ন্যায়বিচার এবং ধার্মিকতা প্রথম শতাব্দীতে দুর্বোধ্য হয়েছিল?
৮ যিহোবার ন্যায়বিচারের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে এইধরনের স্পষ্টীকরণ, সা.কা. প্রথম শতাব্দীতে বিশেষভাবে প্রয়োজন হয়েছিল। যিহূদী প্রাচীন এবং ধর্মীয় নেতারা—অধ্যক্ষগণ, ফরীশী এবং অন্যান্যেরা—ন্যায়বিচার ও ধার্মিকতা সম্বন্ধে এক বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি ঘোষণা ও প্রদর্শন করেছিলেন। ফলে, সাধারণ লোকেরা যারা অধ্যক্ষ ও ফরীশীদের দ্বারা স্থাপিত দাবিগুলির যোগ্যরূপে জীবনযাপন করাকে অসম্ভব হিসাবে দেখতে পেয়েছিলেন তারা সম্ভবত মনে করেছিলেন যে ঈশ্বরের ধার্মিকতা নাগালের বাইরে। (মথি ২৩:৪; লূক ১১:৪৬) যীশু দেখিয়েছিলেন যে বিষয়টি তা ছিল না। তিনি এই সাধারণ লোকেদের মধ্যে থেকে তাঁর শিষ্যদের বেছে নিয়েছিলেন এবং তাদের ঈশ্বরের ধার্মিক মানদণ্ডগুলি শিক্ষা দিয়েছিলেন।—মথি ৯:৩৬; ১১:২৮-৩০.
৯, ১০. (ক) কিভাবে অধ্যক্ষ ও ফরীশীরা তাদের ধার্মিকতা উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছিলেন? (খ) কিভাবে এবং কেন যীশু প্রকাশ করেছিলেন যে অধ্যক্ষ ও ফরীশীদের অভ্যাসগুলি অসাড় ছিল?
৯ অপরদিকে, ফরীশীরা প্রকাশ্যে প্রার্থনা কিংবা দান করার দ্বারা তাদের “ধর্ম্মকর্ম্ম [“ধার্মিকতা,” “NW”]” প্রদর্শন করার সুযোগ খুঁজতেন। (মথি ৬:১-৬) তারা অগণিত ব্যবস্থা ও ধর্মানুশাসন—যেগুলির অনেকগুলিই তাদের নিজেদের তৈরি—সেগুলির প্রতি অনুগত থাকার দ্বারাও তাদের ধার্মিকতা প্রকাশ করার চেষ্টা করেছিলেন। এইধরনের প্রচেষ্টাগুলি তাদের “ন্যায়বিচার ও ঈশ্বর-প্রেম উপেক্ষা” করতে পরিচালিত করেছিল। (লূক ১১:৪২) বাহ্যিকভাবে, তারা হয়ত ধার্মিক বলে প্রতীয়মান হয়েছিলেন কিন্তু ভিতরে তারা “অধর্ম্মে” অথবা অধার্মিকতায় “পরিপূর্ণ” ছিলেন। (মথি ২৩:২৮) সাধারণভাবে বলতে গেলে, তারা ঈশ্বরের ধার্মিকতা সম্বন্ধে খুব সামান্যই জানতেন।
১০ সেই কারণে, যীশু তাঁর অনুগামীদের সতর্ক করেছিলেন: “অধ্যাপক ও ফরীশীদের অপেক্ষা তোমাদের ধার্ম্মিকতা যদি অধিক না হয়, তবে তোমরা কোন মতে স্বর্গ-রাজ্যে প্রবেশ করিতে পাইবে না।” (মথি ৫:২০) যীশুর দ্বারা প্রদর্শিত ঐশিক ন্যায়বিচার এবং অধ্যক্ষ ও ফরীশীদের সংকীর্ণমনের আত্মধার্মিকতার স্পষ্ট বৈষম্য, তাদের মধ্যে প্রায়ই সংঘটিত বিতর্কের কারণ ছিল।
ঐশিক ন্যায়বিচার বনাম বিকৃত ন্যায়বিচার
১১. (ক) কেন ফরীশীরা যীশুকে বিশ্রামবারে সুস্থ করা সম্বন্ধে প্রশ্ন করেছিলেন? (খ) যীশুর উত্তর কী প্রকাশ করেছিল?
১১ সাধারণ কাল ৩১ সালের বসন্তে গালীলে তাঁর পরিচর্যার সময়, যীশু একটি সমাজগৃহে একজন ব্যক্তিকে দেখতে পেয়েছিলেন যার একটি হাত শুকিয়ে গিয়েছিল। যেহেতু সেই দিনটি ছিল বিশ্রামবার, তাই ফরীশীরা যীশুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন: “বিশ্রামবারে কি সুস্থ করা বিধেয়?” এই দরিদ্র ব্যক্তির ভোগান্তির জন্য আন্তরিক উদ্বিগ্নতা বোধ করার চেয়ে, তারা যীশুকে দোষারোপ করার একটি ছুতো খুঁজে পেতে আকাঙ্ক্ষী ছিলেন, যেমন তাদের প্রশ্নটি প্রকাশ করেছিল। এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই যে যীশু তাদের কঠিন হৃদয়ের কারণে দুঃখিত হয়েছিলেন! তিনি তখন যথাযথভাবে একই ধরনের প্রশ্ন ফরীশীদের প্রতি করেছিলেন: “বিশ্রামবারে কি করা বিধেয়? ভাল করা?” তারা যখন নীরব ছিলেন, তখন যীশু তাঁর নিজ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন তাদের এটি জিজ্ঞাসা করার দ্বারা যে বিশ্রামবারে একটি মেষ যদি গর্তে পড়ে যেত তাহলে তারা কি সেটিকে তুলতেন না।b “মেষ হইতে মনুষ্য আরও কত শ্রেষ্ঠ!” অখণ্ডনীয় যুক্তির দ্বারা যীশু বর্ণনা করেছিলেন। “অতএব বিশ্রামবারে সৎকর্ম্ম করা বিধেয় [কিংবা, সঠিক],” তিনি উপসংহারে বলেছিলেন। মানুষের পরম্পরাগত রীতির দ্বারা ঈশ্বরের ন্যায়বিচারকে কখনও ব্যাহত হতে দেওয়া উচিত নয়। ওই বিষয়টি স্পষ্ট করে, যীশু সামনে এগিয়ে গিয়ে সেই ব্যক্তির হাত সুস্থ করেছিলেন।—মথি ১২:৯-১৩; মার্ক ৩:১-৫.
১২, ১৩. (ক) অধ্যক্ষ ও ফরীশীদের বিপরীতে, কিভাবে যীশু পাপীদের সাহায্য করার ক্ষেত্রে তাঁর আগ্রহ দেখিয়েছিলেন? (খ) ঐশিক ন্যায়বিচার ও আত্মধার্মিকতার মধ্যে পার্থক্য কী?
১২ ফরীশীরা শারীরিকভাবে অক্ষমদের প্রতি যদি বা সামান্য উদ্বিগ্নতা দেখিয়েও থাকেন কিন্তু যারা আধ্যাত্মিকভাবে দরিদ্র ছিলেন তাদের প্রতি একেবারেই উদ্বিগ্নতা দেখাননি। ধার্মিকতা সম্বন্ধে তাদের বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি করগ্রাহী ও পাপীদের অবজ্ঞা করতে ও ঘৃণার চোখে দেখতে পরিচালিত করেছিল। (যোহন ৭:৪৯) তাসত্ত্বেও, এইধরনের অনেকে যীশুর শিক্ষার প্রতি সাড়া দিয়েছিলেন ও ন্যায়বিচার করার চেয়ে তাঁর সাহায্য করার আকাঙ্ক্ষাকে নিঃসন্দেহে উপলব্ধি করেছিলেন। (মথি ২১:৩১; লূক ১৫:১) কিন্তু, ফরীশীরা আধ্যাত্মিকভাবে অসুস্থদের সুস্থ করা সম্বন্ধীয় যীশুর প্রচেষ্টাগুলির মর্যাদাহানি করেছিলেন। “এ ব্যক্তি পাপীদিগকে গ্রহণ করে, ও তাহাদের সহিত আহার ব্যবহার করে,” তারা বচসা করে বলেছিলেন। (লূক ১৫:২) তাদের অভিযোগের উত্তরে, যীশু আবারও একটি মেষপালকের দৃষ্টান্ত ব্যবহার করেছিলেন। একজন মেষপালক তার একটি হারানো মেষ খুঁজে পেলে যেভাবে আনন্দ করেন, তদ্রূপ একজন পাপী অনুতপ্ত হলে স্বর্গের দূতগণও আনন্দ করেন। (লূক ১৫:৩-৭) যীশু নিজেও আনন্দিত হয়েছিলেন যখন তিনি সক্কেয়কে তার পূর্বের পাপপূর্ণ আচরণ থেকে অনুতপ্ত হতে সাহায্য করতে পেরেছিলেন। “যাহা হারাইয়া গিয়াছিল, তাহার অন্বেষণ ও পরিত্রাণ করিতে মনুষ্যপুত্ত্র আসিয়াছেন,” তিনি বলেছিলেন।—লূক ১৯:৮-১০.
১৩ এই বাদানুবাদগুলি ঐশিক ন্যায়বিচার যা সুস্থ ও রক্ষা করার চেষ্টা করে এবং আত্মধার্মিকতা যা অল্প কিছুজনকে উচ্চীকৃত কিন্তু বেশিজনকে অবজ্ঞা করার চেষ্টা করে সেগুলির পার্থক্যকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে। অসাড় আচারানুষ্ঠান এবং মানুষের তৈরি পরম্পরাগত রীতি অধ্যাপক ও ফরীশীদের উদ্ধত হতে এবং আত্মগর্ব করতে পরিচালিত করেছিল কিন্তু যীশু উপযুক্তভাবেই উল্লেখ করেছিলেন যে তারা “ব্যবস্থার মধ্যে গুরুতর বিষয়—ন্যায়বিচার, দয়া ও বিশ্বাস—পরিত্যাগ,” করেছেন। (মথি ২৩:২৩) আমরা যা কিছু করি তাতে প্রকৃত ন্যায়বিচার অনুশীলন করার জন্য আমরা যেন যীশুকে অনুকরণ করি আর আত্মধার্মিকতার ফাঁদের প্রতিও সতর্ক হই।
১৪. যীশুর আশ্চর্য কাজগুলির একটি কিভাবে দেখিয়েছিল যে ঐশিক ন্যায়বিচার একজন ব্যক্তির পরিস্থিতিগুলিকে বিবেচনা করে?
১৪ যীশু যদিও ফরীশীদের স্বেচ্ছাচারী আইনগুলিকে উপেক্ষা করেছিলেন কিন্তু তিনি মোশির ব্যবস্থা পালন করেছিলেন। (মথি ৫:১৭, ১৮) তা করার ক্ষেত্রে, তিনি ওই ধার্মিক ব্যবস্থার কঠোর অর্থকে এর নীতিগুলি অগ্রাহ্য করতে অনুমোদন করেননি। ১২ বছর যাবৎ রক্তস্রাবে ভোগা একজন স্ত্রীলোক যখন তাঁর পোশাক স্পর্শ করে সুস্থ হয়েছিলেন, তখন যীশু তাকে বলেছিলেন: “বৎসে! তোমার বিশ্বাস তোমাকে সুস্থ করিল; শান্তিতে চলিয়া যাও।” (লূক ৮:৪৩-৪৮) যীশুর সহানুভূতিপূর্ণ বাক্যগুলি নিশ্চিত করেছিল যে ঈশ্বরের ন্যায়বিচার তার পরিস্থিতিকে বিবেচনা করেছিল। যদিও তিনি রীতি অনুসারে অশুচি ছিলেন এবং জনতার মধ্যে থাকার দ্বারা বৈধভাবে মোশির ব্যবস্থা লঙ্ঘন করেছিলেন, তবুও তার বিশ্বাস পুরস্কারের যোগ্য হয়েছিল।—লেবীয় ১৫:২৫-২৭. রোমীয় ৯:৩০-৩৩ পদের সঙ্গে তুলনা করুন।
প্রত্যেকের জন্য ধার্মিকতা
১৫, ১৬. (ক) প্রতিবেশীসুলভ শমরীয় সম্বন্ধে যীশুর দৃষ্টান্তটি ন্যায়বিচার সম্বন্ধে আমাদের কী শিক্ষা দেয়? (খ) আমাদের কেন “অতি ধার্ম্মিক” হওয়া পরিহার করা উচিত?
১৫ এটির করুণাপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের উপর জোর দেওয়া ছাড়াও, যীশু তাঁর শিষ্যদের শিক্ষা দিয়েছিলেন যে ঐশিক ন্যায়বিচার সমস্ত লোককে অন্তর্ভুক্ত করবে। তাঁর প্রতি যিহোবার ইচ্ছা ছিল যে “তিনি জাতিগণের কাছে ন্যায়বিচার উপস্থিত করিবেন।” (যিশাইয় ৪২:১) এটি ছিল যীশুর সর্বাধিক সুপরিচিত দৃষ্টান্তগুলির মধ্যে একটির বিষয়, যা হল প্রতিবেশীসুলভ শমরীয়। এই দৃষ্টান্তটি ছিল একজন ব্যবস্থাবেত্তা যিনি “আপনাকে নির্দ্দোষ [“ধার্মিক,” “NW”]” প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন তার দ্বারা উত্থাপিত একটি প্রশ্নের উত্তর। নিঃসন্দেহে তার প্রতিবেশীসুলভ দায়িত্বগুলি যিহূদী লোকেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ করার ইচ্ছায়, তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “আমার প্রতিবাসী কে?” যীশুর দৃষ্টান্তের শমরীয় ঈশ্বরীয় ধার্মিকতা প্রদর্শন করেছিলেন, কারণ তিনি অন্য জাতির একজন অপরিচিত ব্যক্তির সাহায্যার্থে তার সময় ও অর্থ ব্যয় করতে ইচ্ছুক ছিলেন। যীশু প্রশ্নকারীকে উপদেশ দেওয়ার দ্বারা তাঁর দৃষ্টান্তটির উপসংহার করেছিলেন: “তুমিও সেইরূপ কর।” (লূক ১০:২৫-৩৭) অনুরূপভাবে আমরা যদি জাতিগত অথবা উপজাতিগত পটভূমি উপেক্ষা করে সমস্ত লোকের প্রতি উত্তম কাজ করি, তাহলে আমরা ঈশ্বরের ন্যায়বিচারের অনুকারী হব।—প্রেরিত ১০:৩৪, ৩৫.
১৬ অপরপক্ষে, অধ্যক্ষ ও ফরীশীদের উদাহরণ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে আমরা যদি ঐশিক ন্যায়বিচার অনুশীলন করতে চাই, তাহলে আমাদের “অতি ধার্ম্মিক” হওয়া উচিত নয়। (উপদেশক ৭:১৬) লোক দেখানো ধার্মিকতা প্রদর্শনের দ্বারা অন্যদের প্রভাবিত করার চেষ্টা অথবা মানুষের তৈরি নিয়মগুলির প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করা, আমাদের জন্য ঈশ্বরের অনুমোদন নিয়ে আসবে না।—মথি ৬:১.
১৭. ঈশ্বরীয় ন্যায়বিচার প্রদর্শন করা কেন আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ?
১৭ কেন যীশু জাতিগুলির কাছে ঈশ্বরের ন্যায়বিচারের বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট করেছিলেন তার একটি কারণ ছিল যাতে তাঁর সমস্ত শিষ্য এই গুণটি প্রদর্শন করতে শিখতে পারেন। কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ? শাস্ত্র আমাদের “ঈশ্বরের অনুকারী” হতে পরামর্শ দেয় আর ঈশ্বরের সমস্ত পথগুলি ন্যায্য। (ইফিষীয় ৫:১) অনুরূপভাবে, মীখা ৬:৮ পদ ব্যাখ্যা করে যে যিহোবার চাহিদাগুলির একটি হল, আমরা যেন আমাদের ঈশ্বরের সঙ্গে গমনাগমন করার সময় “ন্যায্য আচরণ” করি। এছাড়াও, সফনিয় ২:২, ৩ পদ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, আমরা যদি যিহোবার ক্রোধের দিনে গুপ্ত স্থানে রক্ষা পেতে চাই, তাহলে সেই দিন আসার পূর্বে আমাদের “ধর্ম্মের [“ধার্মিকতার,” “NW”] অনুশীলন” করতে হবে।
১৮. পরবর্তী প্রবন্ধটিতে কোন্ প্রশ্নগুলির উত্তর দেওয়া হবে?
১৮ অতএব এই সংকটপূর্ণ শেষ কাল ন্যায়বিচার অনুশীলন করার জন্য “সুপ্রসন্নতার সময়।” (২ করিন্থীয় ৬:২) আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে, ইয়োবের মত আমরা যদি ‘ধার্ম্মিকতা পরি’ এবং ‘ন্যায়বত্তাকে আমাদের পরিচ্ছদ’ করি, তাহলে যিহোবা আমাদের আশীর্বাদ করবেন। (ইয়োব ২৯:১৪) কিভাবে যিহোবার ন্যায়বিচারে বিশ্বাস, আমাদের আস্থার সঙ্গে ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে সাহায্য করবে? অধিকন্তু, আমরা যখন ধার্মিক “নূতন পৃথিবীর” অপেক্ষায় আছি, তখন ঈশ্বরীয় ন্যায়বিচার কিভাবে আমাদের আধ্যাত্মিকভাবে সুরক্ষিত করে? (২ পিতর ৩:১৩) পরবর্তী প্রবন্ধটি এই প্রশ্নগুলির উত্তর দেবে।
[পাদটীকাগুলো]
a ইব্রীয় শাস্ত্রে, তিনটি মূল শব্দ জড়িত। এগুলির একটি (মিসপাট) প্রায়ই “ন্যায়বিচার” হিসাবে অনূদিত হয়েছে। অন্য দুটি (সিধেক্ এবং সম্পর্কযুক্ত শব্দ সিধেকাহ্) বেশিরভাগ ক্ষেত্রে “ধার্মিকতা” হিসাবে অনূদিত হয়েছে। “ধার্মিকতা” (ডিকাইয়োসিনি) হিসাবে অনূদিত গ্রীক শব্দটি “ধার্মিক অথবা ন্যায়পরায়ণ হওয়ার গুণ” হিসাবে সংজ্ঞায়িত হয়েছে।
b যীশুর উদাহরণটি উত্তমরূপে বাছাইকৃত ছিল কারণ যিহূদীদের মৌখিক ব্যবস্থা বিশ্রামবারে দুর্দশাগ্রস্ত একটি পশুকে সাহায্য করার জন্য তাদের বিশেষভাবে অনুমোদন করেছিল। অন্যান্য কয়েকটি উপলক্ষে, এই একই বিচার্য বিষয়ের উপর বিবাদ উপস্থিত হয়েছিল যেমন, বিশ্রামবারে সুস্থ করা বিধেয় ছিল কি না।—লূক ১৩:১০-১৭; ১৪:১-৬; যোহন ৯:১৩-১৬.
আপনি কি ব্যাখ্যা করতে পারেন?
◻ ঐশিক ন্যায়বিচারের অর্থ কী?
◻ কিভাবে যীশু জাতিগুলিকে ন্যায়বিচার শিক্ষা দিয়েছিলেন?
◻ ফরীশীদের ধার্মিকতা কেন বিকৃত ছিল?
◻ কেন আমাদের ন্যায়বিচার অনুশীলন করা প্রয়োজন?
[৮ পৃষ্ঠার চিত্র]
যীশু ঐশিক ন্যায়বিচারের ব্যাপকতাকে স্পষ্ট করেছিলেন