“অতিথি-সেবায় রত হও”
“পবিত্রগণের অভাবের সহভাগী হও, অতিথি-সেবায় রত হও।”—রোমীয় ১২:১৩.
১. মানবজাতির মৌলিক চাহিদা কী এবং তা কিভাবে প্রকাশ পেয়েছে?
আজকাল, গভীর রাতে অপরিচিত এলাকার নির্জন রাস্তায় হাঁটা এক যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা হতে পারে। কিন্তু ঠিক তেমনি এক ভিড়ের মধ্যে থাকা এবং কাউকে না জানা অথবা চিনতে না পারাও পীড়াদায়ক হতে পারে। বস্তুতপক্ষে, মানবপ্রকৃতির এক অবিচ্ছিন্ন অংশ হচ্ছে যত্ন পাওয়া, আকাঙ্ক্ষিত এবং প্রিয় হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা। কেউই একজন অপরিচিত ব্যক্তি বা বাইরের লোকের মত আচরণ পেতে পছন্দ করে না।
২. আমাদের সাহচর্যের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে যিহোবা কিভাবে ব্যবস্থা করেছেন?
২ সমস্ত কিছুর নির্মাতা এবং সৃষ্টিকর্তা, যিহোবা ঈশ্বর, মানবজাতির সাহচর্যের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে ভালভাবে জানেন। মানব সৃষ্টির পরিকল্পনাকারী হিসাবে, সৃষ্টির প্রারম্ভ থেকেই ঈশ্বর জানতেন যে “মনুষ্যের একাকী থাকা ভাল নয়,” এবং এই সম্বন্ধে তিনি কিছু করেছিলেন। (আদিপুস্তক ২:১৮, ২১, ২২) মানুষদের প্রতি যিহোবা এবং তাঁর দাসদের দ্বারা প্রকাশিত দয়াসুলভ আচরণের উদাহরণগুলি দিয়ে বাইবেলের বিবরণ পরিপূর্ণ। এটি আমাদের শিখতে সাহায্য করে কিভাবে অপরের আনন্দ ও সন্তুষ্টির জন্য এবং আমাদের নিজেদের তৃপ্তির জন্য “অতিথি-সেবায় রত” হওয়া যায়।—রোমীয় ১২:১৩.
অপরিচিতদের প্রতি অনুরাগ
৩. অতিথি-সেবার মৌলিক অর্থকে ব্যাখ্যা করুন।
৩ বাইবেলে ব্যবহৃত “অতিথি-সেবা” শব্দটি অনুবাদিত হয়েছে গ্রীক শব্দ ফিলোক্সেনিয়া থেকে, যা দুটি মূল শব্দ দ্বারা গঠিত হয়েছে যেগুলির অর্থ “প্রেম” এবং “অপরিচিত।” সুতরাং, অত্যাবশ্যকীয়ভাবে অতিথি-সেবার অর্থ “অপরিচিতদের প্রতি প্রেম।” কিন্তু এটি শুধুমাত্র লৌকিকতা বা সৌজন্যতামূলক ব্যাপার নয়। এটি একজনের অনুভূতি এবং স্নেহকে জড়িত করে। জেমস্ স্ট্রং এর এক্সহস্টিভ কন্কোরডেন্স অফ দ্যা বাইবেল অনুসারে ফিলিও ক্রিয়া পদটির অর্থ, “একজন বন্ধু হওয়া (অনুরাগী হওয়া [কোন ব্যক্তিবিশেষ বা বস্তুর প্রতি]), স্নেহ থাকা (যা আবেগ বা অনুভূতির সাথে সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তিগত আসক্তিকে চিহ্নিত করে)।” অতএব অতিথি-সেবা, নীতির উপর ভিত্তি করা প্রেমকেও অতিক্রম করে, সম্ভবত যা কর্তব্যবোধ বা বাধ্যবাধকতা থেকে এসে থাকে। এটি সাধারণতঃ অকৃত্রিম অনুরাগ, স্নেহ এবং বন্ধুত্বের এক অভিব্যক্তি।
৪. কাদের প্রতি অতিথি-সেবা প্রদর্শন করা উচিত?
৪ এই অনুরাগ এবং স্নেহের গ্রহীতা হচ্ছে “অপরিচিত” ব্যক্তি (গ্রীক, জেনোস)। এটি কে হতে পারে? পুনরায় স্ট্রং এর কন্কোরডেন্স জেনোস শব্দটিকে সংজ্ঞায়িত করে, ‘বিদেশী (আক্ষরিকভাবে প্রবাসী, বা রূপকভাবে নতুন) হিসাবে; একজন অতিথি বা (অপরদিকে) একজন অপরিচিত।’ সুতরাং বাইবেলে দৃষ্টান্তরূপে বর্ণিত অতিথি-সেবা, দয়া প্রদর্শনকে প্রতিফলিত করতে পারে যা এমন একজনের প্রতি ব্যক্ত করা হয় যার প্রতি আমরা অনুরাগী অথবা এটি এক সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তির প্রতি প্রসারিত হতে পারে। যীশু ব্যাখ্যা করেছিলেন: “যাহারা তোমাদিগকে প্রেম করে, তাহাদিগকেই প্রেম করিলে তোমাদের কি পুরস্কার হইবে? করগ্রাহীরাও কি সেই মত করে না? আর তোমরা যদি কেবল আপন আপন ভ্রাতৃগণকে মঙ্গলবাদ কর, তবে অধিক কি কর্ম্ম কর? পরজাতীয়েরাও কি সেইরূপ করে না?” (মথি ৫:৪৬, ৪৭) অকৃত্রিম অতিথি-সেবা, কুসংস্কার এবং আশঙ্কার দ্বারা উৎপন্ন বিভাগ এবং প্রভেদকে অতিক্রম করে।
যিহোবা, সিদ্ধ অতিথিসেবক
৫, ৬. (ক) যীশুর মনে কী ছিল যখন তিনি বলেছিলেন, “তোমাদের স্বর্গীয় পিতা যেমন সিদ্ধ”? (খ) যিহোবার উদারতা কিভাবে প্রদর্শিত হয়েছে?
৫ উপরে যেমন উদ্ধৃত করা হয়েছে, মানবজাতির একে অপরের প্রতি প্রেম প্রকাশের অভাব উল্লেখ করার পর যীশু এই মন্তব্যটি যুক্ত করেছিলেন: “অতএব তোমাদের স্বর্গীয় পিতা যেমন সিদ্ধ, তোমরাও, তেমনি সিদ্ধ হও।” (মথি ৫:৪৮) অবশ্যই, যিহোবা প্রতিটি ক্ষেত্রে সিদ্ধ। (দ্বিতীয় বিবরণ ৩২:৪) কিন্তু, যীশু যিহোবার সিদ্ধতার একটি নির্দিষ্ট দিকের উপর আলোকপাত করেছিলেন, যেমন তিনি পূর্বেই বলেছিলেন: “[ঈশ্বর] ভাল মন্দ লোকদের উপরে আপনার সূর্য্য উদিত করেন, এবং ধার্ম্মিক অধার্ম্মিকগণের উপরে জল বর্ষান।” (মথি ৫:৪৫) দয়া প্রদর্শনের ক্ষেত্রে যিহোবা কোন পক্ষপাত প্রদর্শন করেন না।
৬ সৃষ্টিকর্তা হিসাবে, যিহোবা সমস্ত কিছুর মালিক। যিহোবা বলেন “বনের সমস্ত জন্তু আমার, সহস্র সহস্র পর্ব্বতীয় পশু আমার। আমি পর্ব্বতগণের সমস্ত পক্ষীকে জানি, মাঠের প্রাণী সকল আমার সম্মুখবর্ত্তী।” (গীতসংহিতা ৫০:১০, ১১) তথাপি, তিনি স্বার্থপরভাবে কোন কিছুই কুক্ষিগত করে রাখেন না। তাঁর উদারতার কারণে তিনি তাঁর সকল প্রাণীর জন্য সরবরাহ করে থাকেন। গীতরচক যিহোবা সম্বন্ধে বলেছিলেন: “তুমিই আপন হস্ত মুক্ত করিয়া থাক, সমুদয় প্রাণীর বাঞ্ছা পূর্ণ করিয়া থাক।”—গীতসংহিতা ১৪৫:১৬.
৭. অপরিচিত এবং যাদের প্রয়োজন তাদের প্রতি যিহোবা যেভাবে আচরণ করেছেন তা থেকে আমরা কী শিখতে পারি?
৭ তাদের যা কিছু প্রয়োজন যিহোবা লোকদেরকে তা দেন—এমনকি সেই লোকদেরও যারা তাঁকে জানে না, যারা তাঁর কাছে অপরিচিত। পৌল এবং বার্ণবা লুস্ত্রা নগরে প্রতিমা পূজকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে যিহোবা “আপনাকে সাক্ষ্যবিহীন রাখেন নাই, কেননা, তিনি মঙ্গল করিতেছেন, আকাশ হইতে আপনাদিগকে বৃষ্টি এবং ফলোৎপাদক ঋতুগণ দিয়া ভক্ষ্যে ও আনন্দে আপনাদের হৃদয় পরিতৃপ্তি করিয়া আসিতেছেন।” (প্রেরিত ১৪:১৭) বিশেষভাবে যাদের প্রয়োজন, তাদের প্রতি যিহোবা দয়াবান এবং উদার। (দ্বিতীয় বিবরণ ১০:১৭, ১৮) দয়া এবং উদারতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে যিহোবার কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে—অপরের প্রতি—অতিথিপরায়ণ হয়ে।
৮. আমাদের আধ্যাত্মিক প্রয়োজনের প্রতি যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে যিহোবা কিভাবে উদারতা দেখিয়েছেন?
৮ তাঁর প্রাণীদের বস্তুগত প্রয়োজন পর্যাপ্তভাবে সরবরাহ করার সাথে সাথে, যিহোবা আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রেও তাদের প্রয়োজনীয়তার প্রতি যত্ন নেন। আধ্যাত্মিকভাবে আমরা যে গুরুতর অবস্থায় ছিলাম, আমাদের মধ্যে কেউ তা উপলব্ধি করার পূর্বেই, আমাদের আধ্যাত্মিক মঙ্গল সাধনের জন্য যিহোবা সর্বোচ্চ উদার উপায়ে কার্য করেছেন। রোমীয় ৫:৮, ১০ পদে আমরা পড়ি: “ঈশ্বর আমাদের প্রতি তাঁহার নিজের প্রেম প্রদর্শন করিতেছেন; কারণ আমরা যখন পাপী ছিলাম, তখনও খ্রীষ্ট আমাদের নিমিত্ত প্রাণ দিলেন। . . . যখন আমরা শত্রু ছিলাম, তখন . . . ঈশ্বরের পুত্ত্রের মৃত্যু দ্বারা সম্মিলিত হইলাম।” সেই ব্যবস্থা পাপপূর্ণ মানবজাতিকে আমাদের স্বর্গীয় পিতার সাথে একটি সুখী পারিবারিক সম্পর্কে আসতে সম্ভব করেছে। (রোমীয় ৮:২০, ২১) এছাড়া যিহোবা এও দেখেছিলেন যে, আমাদের যথার্থ পরিচালনা ও নির্দেশনার সরবরাহ করা হয়েছে, যাতে করে আমাদের পাপপূর্ণ এবং অসিদ্ধ অবস্থা সত্ত্বেও আমরা জীবনে সাফল্য আনতে পারি।—গীতসংহিতা ১১৯:১০৫; ২ তীমথিয় ৩:১৬.
৯, ১০. (ক) আমরা কেন বলতে পারি যে যিহোবা হচ্ছেন সিদ্ধ অতিথিসেবক? (ক) এই ক্ষেত্রে সত্য উপাসকদের কিভাবে যিহোবাকে অনুকরণ করা উচিত?
৯ এই পরিপ্রেক্ষিতে, আমরা বলতে পারি যে বিভিন্ন দিক দিয়ে যিহোবা হলেন প্রকৃতই সিদ্ধ অতিথিসেবক। তিনি দুঃখী, ক্ষুদ্রজন এবং অবনতদের অবজ্ঞা করেন না। তিনি অপরিচিতদের, এমনকি তাঁর শত্রুদের প্রতি অকৃত্রিম আগ্রহ ও উদ্বিগ্নতা দেখিয়ে থাকেন এবং তিনি কোন বস্তুগত প্রতিদান আশা করেন না। এই সমস্ত বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে, তিনি কি একজন সিদ্ধ অতিথিসেবকের সর্বোত্তম উদাহরণ নন?
১০ এইধরনের একজন প্রেমময়-দয়ালু এবং উদার ঈশ্বর হিসাবে, যিহোবা চান তাঁর উপাসকেরা তাঁকে অনুকরণ করুক। সমস্ত বাইবেলে আমরা এই দয়ালু গুণের উল্লেখযোগ্য উদাহরণগুলি দেখতে পাই। দি এনসাইক্লোপিডিয়া যুডাইকা বর্ণনা করে যে, “প্রাচীন ইস্রায়েলে অতিথি-সেবা শুধুমাত্র একটি উত্তম ভদ্রতা প্রদর্শনের বিষয় ছিল না, বরঞ্চ এটি একটি নৈতিক বিধান ছিল . . . .ক্লান্ত ভ্রমণকারীকে স্বাগত জানান এবং অপরিচিতকে গ্রহণ করা সম্বন্ধীয় বাইবেলের প্রথা একটি উৎস ছিল, যা থেকে অতিথি-সেবা এবং এর সাথে সম্পর্কযুক্ত অন্যান্য বিষয়গুলি যিহূদী পরম্পরায় এক উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন গুণ হিসাবে উন্নতি লাভ করেছিল।” বিশেষ কোন জাতীয়তাবাদী বা সংস্কৃতির ট্রেডমার্ক হওয়ার চেয়েও অতিথি-সেবা, যিহোবার সকল সত্য উপাসকদের একটি বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত।
অতিথিসেবক হিসাবে দূতেদের সেবা করা
১১. কোন্ উল্লেখযোগ্য উদাহরণ দেখায় যে অতিথি-সেবা অপ্রত্যাশিত আশীর্বাদগুলি নিয়ে এসেছিল? (এছাড়া দেখুন আদিপুস্তক ১৯:১-৩; বিচারকর্ত্তৃগণ ১৩:১১-১৬.)
১১ অতিথিসেবা প্রদর্শনের সর্বাধিক পরিচিত বাইবেল বিবরণগুলির মধ্যে একটি হল অব্রাহাম এবং সারা সম্বন্ধে যখন তারা হিব্রোণের নিকটে মম্রির এলোন বনের কাছে তাম্বুতে ছিলেন। (আদিপুস্তক ১৮:১-১০; ২৩:১৯) নিঃসন্দেহে, প্রেরিত পৌলের এই ঘটনা মনে ছিল যখন তিনি এই চেতনা দেন: “অতিথিসেবা ভুলিয়া যাইও না; কেননা তদ্দ্বারা কেহ কেহ না জানিয়া দূতগণেরও আতিথ্য করিয়াছেন।” (ইব্রীয় ১৩:২) এই বিবরণটির পরীক্ষা আমাদের দেখতে সাহায্য করবে যে, অতিথি-সেবা শুধুমাত্র একটি প্রথা বা লালন-পালনের বিষয় নয়। বরঞ্চ, এটি একটি ঈশ্বরীয় গুণ যা অপূর্ব আশীর্বাদগুলি নিয়ে আসে।
১২. অব্রাহাম কিভাবে অপরিচিতদের প্রতি তার প্রেম প্রদর্শন করেছিলেন?
১২ আদিপুস্তক ১৮:১, ২ পদ ইঙ্গিত করে যে পরিদর্শকেরা অব্রাহামের অপরিচিত ও অপ্রত্যাশিত ছিলেন এবং যতটুকু বলা যায় তিনজন অপরিচিত ব্যক্তি ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। কয়েকজন মন্তব্যকারীদের কথা অনুসারে, প্রাচ্যের লোকেদের মধ্যে প্রথা ছিল যে, একটি অপরিচিত দেশে একজন ভ্রমণকারীর অতিথি-সেবা প্রত্যাশা করার অধিকার ছিল, যদিও সে সেখানকার কাউকে চিনত না। কিন্তু অব্রাহাম সেই অপরিচিতদের বিশেষ অধিকার প্রকাশ করার জন্য অপেক্ষা করেননি; তিনি প্রথমে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এই অপরিচিত ব্যক্তিদের সাক্ষাৎ লাভ করার জন্য তিনি “দৌড়িয়া” গেলেন যারা তার কাছ থেকে কিছুটা দূরে ছিলেন—এই সমস্ত কিছু ঘটেছিল “দিনের উত্তাপ সময়ে” এবং অব্রাহাম তখন ৯৯ বছর বয়স্ক ছিলেন! এটি কি দেখায় না, আমাদের অনুকরণের জন্য কেন পৌল অব্রাহামকে আদর্শ হিসাবে উল্লেখ করেছেন? কারণ অতিথি-সেবার মৌলিক অর্থ, অপরিচিতদের প্রতি অনুরাগ বা প্রেম, তাদের প্রয়োজনের প্রতি উদ্বিগ্নতা। এটি একটি ইতিবাচক গুণ।
১৩. অব্রাহাম কেন পরিদর্শকদের “প্রণিপাত” করেছিলেন?
১৩ বিবরণটি আমাদের আরও বলে যে অপরিচিতদের সাক্ষাৎ লাভ করার পর, অব্রাহাম তাদের নিকটে গিয়ে “ভূমিতে প্রণিপাত” করলেন। সম্পূর্ণ অপরিচিতদের প্রতি প্রণিপাত? হ্যাঁ, অব্রাহামের দ্বারা কৃত প্রণিপাত ছিল একজন সম্মানিত অতিথি বা কোন উচ্চ পদস্থ ব্যক্তিকে সম্ভাষণ জানানোর রীতি, এটি উপাসনা মনে করে বিভ্রান্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই, যেটি কেবলমাত্র ঈশ্বরের জন্য সংরক্ষিত। (তুলনা করুন প্রেরিত ১০:২৫, ২৬; প্রকাশিত বাক্য ১৯:১০.) শুধুমাত্র মাথা নত করাই নয়, কিন্তু “ভূমিতে প্রণিপাত” করার দ্বারা অব্রাহাম এই অপরিচিত ব্যক্তিদের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরূপে সম্মান প্রদান করেছিলেন। যদিও তিনি এক বৃহৎ, সমৃদ্ধ কূলপতি শাসিত পরিবারের মস্তক ছিলেন, তথাপি এই অপরিচিত ব্যক্তিদের তিনি তার নিজের থেকেও উচ্চতর সম্মানের যোগ্য রূপে গণ্য করেছিলেন। অপরিচিত ব্যক্তিদের প্রতি প্রথাসিদ্ধ সন্দেহ পোষণ করা ও তাদের প্রতি সর্বদা সতর্ক থাকার চেয়ে কতই না ভিন্ন! অব্রাহাম সত্যই এই উক্তির অর্থ প্রদর্শন করেছিলেন: “সমাদরে এক জন অন্যকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান কর।”—রোমীয় ১২:১০.
১৪. অপরিচিতদের প্রতি অতিথি-সেবা প্রদর্শনে অব্রাহামের কোন্ প্রচেষ্টা এবং ত্যাগস্বীকার যুক্ত ছিল?
১৪ বিবরণটির বাকি অংশ দেখায় যে অব্রাহামের অনুভূতি ছিল অকৃত্রিম। খাদ্যও ছিল অসাধারণ। যদিও একটি বড় পরিবারে অনেক গৃহপালিত পশু থাকে, তবুও “উৎকৃষ্ট কোমল এক গোবৎস” প্রতিদিনের সাধারণ খাদ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত নয়। এলাকার প্রচলিত প্রথা সম্বন্ধে, জন কিটোর প্রতিদিনের বাইবেল উদাহরণ (ইংরাজি) মন্তব্য করে: “কোন উৎসব, অথবা কোন অপরিচিত ব্যক্তির আগমন ছাড়া এইধরনের বিলাস-বহুল খাদ্য কখনও প্রস্তুত করা হত না; এমনকি যারা অসংখ্য পশুপালের অধিকারী ছিল তাদের ক্ষেত্রেও শুধুমাত্র এইধরনের উপলক্ষগুলিতে কখনও পশুর মাংস খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হত।” উষ্ণ আবহাওয়ার জন্য দ্রুত পচনশীল খাবার সংরক্ষণ করা যেত না, তাই সেইধরনের খাবার প্রস্তুত করার জন্য সমস্ত কিছু তখনই করতে হত। এটি কোন আশ্চর্যের বিষয় নয় যে এই সংক্ষিপ্ত বিবরণে, “শীঘ্র” বা “ত্বরা করিয়া” শব্দ তিনবার উচ্চারিত হতে দেখা যায় এবং অব্রাহাম খাবার তৈরি পাওয়ার জন্য আক্ষরিকভাবে “গেলেন [“দৌড়ালেন,” NW]!”—আদিপুস্তক ১৮:৬-৮.
১৫. অব্রাহাম যেভাবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তার পরিপ্রেক্ষিতে, অতিথি-সেবা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে বস্তুগত ব্যবস্থার প্রতি যথার্থ দৃষ্টিভঙ্গি কী?
১৫ যাইহোক, কাউকে প্রভাবিত করার জন্য শুধুমাত্র একটি বড় ভোজ প্রস্তুত করাই উদ্দেশ্য নয়। এমনকি যদিও অব্রাহাম এবং সারা খাদ্য প্রস্তুত এবং পরিবেশন করার জন্য সমস্ত প্রচেষ্টা করেছিলেন, লক্ষ্য করুন পূর্বে অব্রাহাম এটিকে কিভাবে উল্লেখ করেন: “বিনয় করি, কিঞ্চিত জল আনাইয়া দিই, আপনারা পা ধুইয়া এই বৃক্ষতলে বিশ্রাম করুন, এবং কিছু খাদ্য [“এক টুকরো রুটি,” NW] আনিয়া দিই, তাহা দ্বারা প্রাণ আপ্যায়িত করুন, পরে পথে অগ্রসর হইবেন; কেননা ইহারই নিমিত্তে আপন দাসের নিকটে আগত হইলেন।” (আদিপুস্তক ১৮:৪, ৫) সেই “টুকরো রুটি” এক হৃষ্টপুষ্ট গোবৎসের সাথে উত্তম ময়দার পিষ্টক, দধি, দুগ্ধ সহ একটি বড় ভোজে পরিণত হয়েছিল—এক রাজার জন্য উপযুক্ত একটি ভোজ। এখানে শিক্ষামূলক বিষয়টি কী? যখন অতিথি-সেবা প্রদর্শন করা হবে তখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অথবা যে বিষয়টির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হবে সেটি এই নয় যে, খাবার বা পানীয় কতটা জাঁক-জমকপূর্ণ হবে অথবা কতটা বিশদ আমোদ-প্রমোদের এবং অন্যান্য কিছুর ব্যবস্থা করা হবে। একজন মূল্যবান বস্তু সরবরাহ করতে সমর্থ কি না তার উপর অতিথি-সেবা নির্ভর করে না। বরঞ্চ, এটি অন্যদের মঙ্গল সাধনের জন্য অকৃত্রিম উদ্বেগ এবং একজনের পক্ষে যতখানি প্রসারিতভাবে সম্ভব অন্যদের প্রতি মঙ্গল করার ইচ্ছার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। বাইবেলের একটি প্রবাদ বলে, “প্রণয়ভাবের সহিত শাক ভক্ষণ ভাল, তবু দ্বেষভাবের সহিত পুষ্ট গোরু ভাল নয়,” আর সেখানেই প্রকৃত অতিথি-সেবার চাবিটি শায়িত।—হিতোপদেশ ১৫:১৭.
১৬. পরিদর্শকদের জন্য তিনি যা করেছিলেন তাতে অব্রাহাম কিভাবে আধ্যাত্মিক বিষয়গুলির প্রতি তার উপলব্ধিবোধ দেখিয়েছিলেন?
১৬ যাইহোক, আমরা অবশ্যই লক্ষ্য করব যে, সম্পূর্ণ ঘটনায় একটি আধ্যাত্মিক আভাস রয়েছে। যে কোনভাবেই হোক অব্রাহাম উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে সেই পরিদর্শকেরা ছিলেন যিহোবার বার্তাবাহক। এটি নির্দেশিত হয়েছিল, তার এই শব্দগুলির দ্বারা তাদেরকে সম্ভাষণ জানানোর মাধ্যমে: “হে প্রভো [“যিহোবা,” NW] বিনয় করি, যদি আমি আপনার দৃষ্টিতে অনুগ্রহের পাত্র হইয়া থাকি, তবে আপনার এই দাসের নিকট হইতে অগ্রসর হইবেন না।”a (আদিপুস্তক ১৮:৩; তুলনা করুন যাত্রাপুস্তক ৩৩:২০.) অব্রাহাম পূর্বে জানতেন না তার জন্য তাদের কাছে কোন বার্তা ছিল কি না, বা তারা এমনিই সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। যাই হোক না কেন, তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে যিহোবার উদ্দেশ্যের একটি পরিপূর্ণতা হতে যাচ্ছিল। এই ব্যক্তিবিশেষেরা যিহোবার কাছ থেকে কোন দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। যদি তিনি তাদের সাহায্য করার জন্য কিছু করতে পারেন, তাহলে সেটি তার জন্য আনন্দদায়ক হবে। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে যিহোবার দাসেরা সর্বোত্তম বিষয়ের যোগ্য এবং সেই পরিস্থিতিতে তিনি তাদের জন্য সর্বোত্তম বস্তুর ব্যবস্থা করেছিলেন। এইরূপ করার দ্বারা, আধ্যাত্মিক আশীর্বাদ আসবে, তার নিজের জন্য বা অন্যের জন্য। পরিশেষে, অব্রাহাম এবং সারা তাদের আন্তরিক অতিথি-সেবার জন্য প্রচুররূপে আশীর্বাদপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।—আদিপুস্তক ১৮:৯-১৫; ২১:১, ২.
অতিথিপরায়ণ লোকেরা
১৭. তাদের মধ্যে যে অপরিচিত এবং দুঃখীরা ছিল তাদের বিষয়ে যিহোবা ইস্রায়েলীদের কাছ থেকে কী চেয়েছিলেন?
১৭ অব্রাহামের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ তার থেকে আসা জাতিটি ভুলে যায়নি। যিহোবা ইস্রায়েলীয়দের যে নিয়ম দিয়েছিলেন তা তাদের মধ্যে অবস্থিত অপরিচিতদের প্রতি অতিথি-সেবা প্রদর্শনের ব্যবস্থাকেও অন্তর্ভুক্ত করেছিল। “তোমাদের নিকটে তোমাদের স্বদেশীয় লোক যেমন, তোমাদের সহপ্রবাসী বিদেশী লোকও তেমনি হইবে; তুমি তাহাকে আপনার মত প্রেম করিও; কেননা মিসর দেশে তোমরাও বিদেশী ছিলে; আমি সদাপ্রভু তোমাদের ঈশ্বর।” (লেবীয় পুস্তক ১৯:৩৪) লোকেদেরকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হত তাদের প্রতি, যাদের বস্তুগত সাহায্যের প্রয়োজন ছিল এবং তাদেরকে উপেক্ষা করা যেত না। যখন যিহোবা তাদের পর্যাপ্ত শস্য দিয়ে আশীর্বাদ করতেন, যখন তারা তাদের উৎসবগুলিতে আনন্দ করত, বিশ্রামবারের বৎসরগুলি এবং অন্যান্য উপলক্ষগুলিতে যখন তারা তাদের কাজ থেকে বিশ্রামে থাকত, তখন লোকেদেরকে সেই দুঃখীদের স্মরণ করতে হত—বিধবাদের, পিতৃহীন বালকদের এবং বিদেশীদের।—দ্বিতীয় বিবরণ ১৬:৯-১৪; ২৪:১৯-২১; ২৬:১২, ১৩.
১৮. যিহোবার অনুগ্রহ এবং আশীর্বাদ লাভ করার সাথে অতিথি-সেবা কতটা গুরুত্বপূর্ণভাবে সম্পর্কযুক্ত?
১৮ যখন তারা এই গুণাবলিগুলি অনুশীলন করতে অবহেলা করেছিল তখন যিহোবা ইস্রায়েলীয়দের সাথে যেভাবে আচরণ করেছিলেন তার মাধ্যমে অপরের এবং বিশেষভাবে যাদের প্রয়োজন তাদের প্রতি, দয়া, উদারতা এবং অতিথি-সেবা প্রদর্শনের গুরুত্ব দেখা যেত। যিহোবা পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন যে অপরিচিত এবং যাদের প্রয়োজন তাদের প্রতি দয়া এবং উদারতা প্রদর্শন তাঁর লোকেদের পক্ষে তাঁর অবিরাম আশীর্বাদগুলি লাভ করার জন্য প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। (গীতসংহিতা ৮২:২, ৩; যিশাইয় ১:১৭; যিরমিয় ৭:৫-৭; যিহিষ্কেল ২২:৭; সখরিয় ৭:৯-১১) যখন জাতিটি এগুলি এবং অন্যান্য চাহিদাগুলি অধ্যবসায়ের সাথে সম্পন্ন করেছিল, তারা সমৃদ্ধি এবং বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে প্রাচুর্য উপভোগ করেছিল। যখন তারা তাদের স্বার্থপর ব্যক্তিগত অভীষ্টে নিমগ্ন হয়ে পড়েছিল এবং যাদের প্রয়োজন তাদের প্রতি এই দয়াপূর্ণ গুণগুলি প্রদর্শন করতে অবহেলা করেছিল, তারা যিহোবার কাছ থেকে নিন্দা লাভ করেছিল এবং পরিশেষে তারা চূড়ান্ত প্রতিকূল বিচারের সম্মুখীন হয়েছিল।—দ্বিতীয় বিবরণ ২৭:১৯; ২৮:১৫, ৪৫.
১৯. আরও কোন্ বিষয়গুলি আমরা অবশ্যই বিবেচনা করব?
১৯ তাহলে, আমাদের জন্য এটি কতই না গুরুত্বপূর্ণ নিজেদের পরীক্ষা করে দেখা যে এই বিষয়ে আমরা যিহোবার প্রত্যাশানুযায়ী জীবনযাপন করছি কি না! জগতের এই স্বার্থপর এবং বিভেদ সৃষ্টিকারী মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে এটি বিশেষভাবে পরীক্ষাযোগ্য। আমরা কিভাবে এই বিভক্ত জগতে খ্রীষ্টীয় অতিথি-সেবা প্রদর্শন করতে পারি? এই বিষয়টিই পরবর্তী প্রবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।
[পাদটীকাগুলো]
a এই বিষয়ের উপর বিশদ আলোচনার জন্য, প্রহরীদুর্গ (ইংরাজি), মে ১৫, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ২১-৩-এ “ঈশ্বরকে কেউ কি দেখেছে?” প্রবন্ধটি দেখুন।
আপনি কি স্মরণ করতে পারেন?
◻ “অতিথি-সেবা” হিসাবে অনুবাদিত বাইবেল শব্দটির অর্থ কী?
◻ অতিথি-সেবা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে কোন্ কোন্ দিক দিয়ে যিহোবা হলেন সিদ্ধ উদাহরণ?
◻ অতিথিপরায়ণ হওয়ার জন্য অব্রাহামকে কোন্ সীমা পর্যন্ত যেতে হয়েছিল?
◻ কেন সকল সত্য উপাসকদের অবশ্যই “অতিথি-সেবায় রত” হতে হবে?