তাদের বিশ্বাস অনুকরণ করুন
“তিনি মৃত হইলেও এখনও কথা কহিতেছেন”
হেবল তার মেষের পালকে পাহাড়ের ধারে শান্তভাবে চরে বেড়াতে দেখছিলেন। সেই সময়ে হয়তো তার মেষেদের থেকে অনেক দূরে একটা হালকা আভার দিকে তার চোখ চলে যায়। তিনি জানতেন যে, ঠিক সেখানে একটা ঘূর্ণায়মান তেজোময় খড়্গ রয়েছে, যা এদন উদ্যানের পথ রোধ করে অনবরত ঘুরেই যাচ্ছে। এক সময় তার বাবা-মা সেখানে থাকতেন কিন্তু এখন তারা ও তাদের সন্তানরা কেউই সেখানে আর প্রবেশ করতে পারে না। কল্পনা করুন সেই পড়ন্ত বিকেলে, তিনি যখন ঊর্ধ্বে এক দৃষ্টে তাকিয়ে তাঁর সৃষ্টিকর্তার বিষয় চিন্তা করছিলেন, তখন ফুরফুরে বাতাস হেবলের চুলকে এলোমেলো করছিল। মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যে যে-ফাটল রয়েছে, তা কি কখনও জুড়বে? হেবল শুধু এটাই চেয়েছিলেন।
আজও, হেবল আপনার সঙ্গে কথা বলেন। আপনি কি তা শুনতে পান? আপনি হয়তো বলবেন যে, এটা অসম্ভব। আদমের এই দ্বিতীয় সন্তান তো কবেই মারা গিয়েছেন। প্রায় ৬০০০ বছর আগে তার মৃতদেহ ধুলোয় মিশে বিলীন হয়ে গিয়েছে। মৃতদের সম্বন্ধে বাইবেল আমাদের শিক্ষা দেয়: “মৃতেরা কিছুই জানে না।” (উপদেশক ৯:৫, ১০) এ ছাড়া, হেবলের উচ্চারিত কোনো কথাই বাইবেলে লিপিবদ্ধ নেই। তাহলে কীভাবেই বা তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন?
প্রেরিত পৌল অনুপ্রাণিত হয়ে হেবলের বিষয়ে এই কথা বলেছিলেন: “তদ্দ্বারা তিনি মৃত হইলেও এখনও কথা কহিতেছেন।” (ইব্রীয় ১১:৪) কীসের দ্বারা হেবল কথা বলছেন? বিশ্বাসের দ্বারা। হেবল ছিলেন সবচেয়ে প্রথম মানুষ, যিনি এই অসাধারণ গুণটি গড়ে তুলেছিলেন। তিনি এতটা দৃঢ় বিশ্বাস প্রদর্শন করেছিলেন যে, তার উদাহরণ হল জীবন্ত, এক উল্লেখযোগ্য মানদণ্ড, যা আজকে আমরা অনুকরণ করতে পারি। আমরা যদি তার বিশ্বাস থেকে শিক্ষা লাভ করি এবং তা অনুকরণ করার চেষ্টা করি, তাহলে হেবলের বিবরণ আমাদের কাছে খুবই বাস্তব ও কার্যকরী উপায়ে কথা বলছে।
কিন্তু বাইবেলে যেহেতু তার সম্বন্ধে এত অল্প কথা বলা হয়েছে, তাই হেবল ও তার বিশ্বাস থেকে আমরা কী শিখতে পারি? আসুন আমরা তা দেখি।
জগৎ যখন নবীন ছিল, তখন বড়ো হয়ে ওঠা
হেবল মানব ইতিহাসের প্রারম্ভের কাছাকাছি সময়ে জন্মেছিলেন। পরবর্তীকালে যিশু হেবলের বিষয়ে বলেছিলেন যে, তিনি ‘জগতের পত্তনের’ সময়ে বেঁচে ছিলেন। (লূক ১১:৫০, ৫১) স্পষ্টতই, যিশু সেই লোকেদের জগৎকে বুঝিয়েছিলেন, যাদের পাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার আশা রয়েছে। যেহেতু হেবল ছিলেন সৃষ্টি থেকে চতুর্থ ব্যক্তি, তাই ঈশ্বর হয়তো তাকেই মুক্তি পাওয়ার যোগ্য এমন প্রথম ব্যক্তি হিসেবে দেখেছিলেন।a স্পষ্টতই, হেবল বড়ো হয়ে ওঠার সময় এমন কেউ ছিল না, যে তার ওপর ভালো প্রভাব ফেলবে।
যদিও জগৎ নবীন ছিল, তবুও দুঃখের কালো ছায়া সেই মানব পরিবারের ওপর এসে পড়েছিল। নিঃসন্দেহে, হেবলের বাবা-মা, আদম ও হবা খুব সুন্দর ও কর্মক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তি ছিল। কিন্তু তারা তাদের জীবনে খুব বড়ো একটা ভুল করেছিল আর তারা তা জানত। একসময় তারা সিদ্ধ ছিল আর তাদের সামনে অনন্ত জীবনের আশা ছিল। এরপর তারা যিহোবা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল আর তাদেরকে তাদের এদন উদ্যানের পরমদেশ গৃহ থেকে বার করে দেওয়া হয়েছিল। তাদের নিজেদের আকাঙ্ক্ষাকে সমস্তকিছুর—এমনকী তাদের বংশধরদের চাহিদাগুলোর—ঊর্দ্ধে রাখার দ্বারা তারা সিদ্ধতা ও অনন্তজীবন হারিয়েছিল।—আদিপুস্তক ২:১৫–৩:২৪.
উদ্যান থেকে নির্বাসিত হওয়ার পর, আদম ও হবা বুঝতে পেরেছিল যে, তাদের পক্ষে বেঁচে থাকা খুব কঠিন। তবুও, যখন তাদের প্রথম সন্তান জন্মেছিল, তখন তারা তার নাম রেখেছিল কয়িন অর্থাৎ “কোনো কিছু উৎপন্ন করা” আর হবা বলেছিলেন: “সদাপ্রভুর সহায়তায় আমার নরলাভ হইল।” তার কথাগুলো এই ইঙ্গিত দেয় যে, এদনে বলা যিহোবার সেই প্রতিজ্ঞার কথা হয়তো তার মনে ছিল, যেখানে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, এক নারী এক ‘বংশ’ উৎপন্ন করবে, যে-বংশ সেই দুষ্ট ব্যক্তিকে ধ্বংস করবে, যে আদম ও হবাকে বিপথে নিয়ে গিয়েছিল। (আদিপুস্তক ৩:১৫; ৪:১) হবা কি এমনটা ভেবেছিলেন যে, ভবিষ্যদ্বাণীতে বলা নারী তিনিই এবং সেই প্রতিজ্ঞাত ‘বংশ’ হল কয়িন?
যদি তাই হয়, তাহলে তিনি খুব বড়ো ভুল করেছিলেন। এ ছাড়াও, কয়িন বড়ো হয়ে ওঠার সময় তিনি ও আদম যদি তার মধ্যে এই ধরনের ধারণাগুলো ঢুকিয়ে দিয়ে থাকেন, তাহলে নিশ্চিতভাবেই তারা তার অসিদ্ধতাজনিত গর্বকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। পরবর্তীকালে হবা দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন, কিন্তু তার সম্বন্ধে আমরা বাহবা দেওয়ার মতো কোনো মন্তব্য খুঁজে পাই না। তারা তার নাম রেখেছিল হেবল, যেটার অর্থ হতে পারে “নিঃশ্বাস ত্যাগ” অথবা “অসার।” (আদিপুস্তক ৪:২) যে-নাম বেছে নেওয়া হয়েছিল তা কি কয়িনের চেয়ে হেবলের প্রতি তাদের যে কম প্রত্যাশা ছিল সেটাকে তুলে ধরেছিল? আমরা তা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না।
যাই হোক না কেন, আজকে বাবা-মারা সেই প্রথম বাবা-মার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারে। আপনার কথা ও কাজের দ্বারা আপনি কি আপনার সন্তানের গর্ব, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও স্বার্থপর মনোভাবকে বাড়িয়ে তুলছেন? নাকি আপনি যিহোবা ঈশ্বরকে ভালোবাসতে এবং তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে শিক্ষা দিচ্ছেন? দুঃখের বিষয় যে, প্রথম বাবা-মা তাদের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছিল। তবুও, তাদের সন্তানদের জন্য আশা ছিল।
হেবল বিশ্বাস গড়ে তুলেছিলেন —কীভাবে?
দুই ছেলে যখন বড়ো হয়ে উঠছিল, তখন সম্ভবত আদম তাদেরকে পরিবারের ভরণপোষণ জোগানোর জন্য যে-কাজ করতে হবে, সেটার জন্য প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। কয়িন কৃষিকাজ বেছে নিয়েছিল; হেবল মেষপাল দেখাশোনার কাজ বেছে নিয়েছিলেন।
কিন্তু হেবল এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কিছু করেছিলেন। বছরের পর বছর ধরে তিনি বিশ্বাস গড়ে তুলেছিলেন, যে-সুন্দর গুণটি সম্বন্ধে পৌল পরে লিখেছিলেন। এটা নিয়ে একটু চিন্তা করুন। অনুকরণ করার মতো কোনো মানুষের উদাহরণ হেবলের সামনে ছিল না। তাহলে কীভাবে তিনি যিহোবা ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস গড়ে তুলেছিলেন? তিনটে দৃঢ় ভিত্তি বিবেচনা করুন, যেগুলোর ওপর হয়তো তিনি তার বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন।
যিহোবার সৃষ্টি। এটা ঠিক যে, যিহোবা ভূমির ওপর অভিশাপ দিয়েছিলেন, যার ফলে কন্টক ও শেয়ালকাঁটা জন্মাতো যা চাষের কাজে বাধা সৃষ্টি করত। তবুও হেবলের পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য মাটি পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য উৎপন্ন করত। আর প্রাণীজগৎ, যার অন্তর্ভুক্ত পাখি ও মাছ; এমনকী পাহাড়-পর্বত, হ্রদ, নদী ও সমুদ্র; অথবা আকাশ, মেঘ, সূর্য, চাঁদ ও তারার ওপর কোনো অভিশাপ ছিল না। হেবল যেদিকেই তাকাতেন সেই দিকেই যিহোবা ঈশ্বর, যিনি সমস্ত কিছুই সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর অগাধ প্রেম, প্রজ্ঞা ও মঙ্গলভাবের প্রমাণ দেখতে পেতেন। (রোমীয় ১:২০) ঈশ্বরের সৃষ্টি ও তাঁর গুণাবলি নিয়ে ধ্যান করা তার বিশ্বাসকে শক্তিশালী করেছিল।
নিশ্চিতভাবেই, হেবল আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোর ওপর ধ্যান করার জন্য সময় করে নিতেন। কল্পনা করুন, তিনি তার পাল চরাচ্ছেন। একজন মেষপালককে অনেকটা পথ হাঁটতে হতো। তিনি তার শান্ত প্রাণীগুলোকে সবুজ ঘাস, ঝর্ণা ও ছায়াযুক্ত আশ্রয়স্থানের সন্ধানে পাহাড়ের ওপর, উপত্যকার মধ্যে দিয়ে, নদীর ধারে নিয়ে যেতেন। ঈশ্বরের সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে মেষেরা সবচেয়ে অসহায় প্রাণী বলে মনে হয়, যেন তাদের এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে মানুষ তাদের পথ দেখায় ও রক্ষা করে। হেবল কি এমনটা মনে করেছিলেন যে, তারও কোনো মানুষের চেয়ে বেশি বিজ্ঞ ও বেশি শক্তিশালী কারো কাছে থেকে নির্দেশনা, সুরক্ষা ও যত্নের প্রয়োজন? কোনো সন্দেহ নেই যে, তার প্রার্থনাতেও তিনি এইরকম অনেক বিষয় প্রকাশ করতেন আর এর ফলে তার বিশ্বাস ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল।
যিহোবার প্রতিজ্ঞাগুলো। আদম ও হবা নিশ্চয় তাদের ছেলেদেরকে এদন উদ্যানের সেই ঘটনা সম্বন্ধে জানিয়েছিল যেটার কারণে তাদেরকে সেখান থেকে বার করে দেওয়া হয়েছিল। তাই, হেবলের কাছে ধ্যান করার মতো অনেক বিষয় ছিল।
যিহোবা বলেছিলেন যে, ভূমি অভিশপ্ত হবে। সেই কথা অনুযায়ী স্পষ্টভাবেই হেবল কন্টক ও শেয়ালকাঁটা জন্মাতে দেখেছিলেন। এ ছাড়াও, যিহোবা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসবের সময়ে হবা যন্ত্রণা ভোগ করবে। হেবলের ভাইবোনেদের জন্মের সময়, নিঃসন্দেহে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, ওই কথাগুলোও সত্য। যিহোবা জানতেন যে, স্বামীর ভালোবাসা ও মনোযোগের প্রতি হবার বাসনা থাকবে আর অপরদিকে আদম তার ওপর কর্তৃত্ব করবে। হেবল তার চোখের সামনে ওই দুঃখজনক বাস্তবতাকে ঘটতে দেখেছিলেন। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে, হেবল দেখেছিলেন যে, যিহোবার বাক্য সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাসযোগ্য। তাই, সেই ‘বংশের’ বিষয়ে ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞাগুলোর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করার জোরালো কারণগুলো হেবলের ছিল, যে-‘বংশ’ এদনে শুরু হওয়া ভুলগুলোকে একদিন শুধরে দেবে।—আদিপুস্তক ৩:১৫-১৯.
যিহোবার দাসেরা। মানব পরিবারের মধ্যে হেবল কোনো ভালো উদাহরণ খুঁজে পাননি কিন্তু, সেই সময়ে পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র বুদ্ধিবিশিষ্ট প্রাণী ছিল না। যিহোবা যখন আদম ও হবাকে উদ্যান থেকে বার করে দিয়েছিলেন, তখন তিনি এটা নিশ্চিত করেছিলেন যে, তারা বা তাদের বংশধর, কেউই যেন সেই পার্থিব পরমদেশে প্রবেশ করতে না পারে। প্রবেশ পথ পাহারা দেওয়ার জন্য যিহোবা উচ্চপদস্থ দূত, করূবদের ও সেইসঙ্গে অনবরত ঘূর্ণায়মাণ তেজোময় খড়্গ স্থাপন করেছিলেন।—আদিপুস্তক ৩:২৪.
কল্পনা করুন, ছোটোবেলা থেকেই হেবল এই করূবদের দেখতেন। যেহেতু তারা মানব দেহ ধারণ করেছিল, তাই হেবল দেখতেন যে, তারা খুবই শক্তিশালী ছিল। আর সেই তেজোময়, অনবরত ঘূর্ণায়মাণ “খড়গ” সশ্রদ্ধ ভয়ও উৎপন্ন করত। হেবল যত বড়ো হতে থাকেন, তিনি কি কখনও এই করূবদের ক্লান্ত হয়ে পড়ে তাদের স্থান ত্যাগ করতে দেখেছিলেন? না। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, দশকের পর দশক ধরে এই বুদ্ধিবিশিষ্ট শক্তিশালী প্রাণীরা ওই একই স্থানে দাঁড়িয়েছিল। এটা থেকে হেবল জানতে পেরেছিলেন যে, যিহোবা ঈশ্বরের ধার্মিক, অবিচল দাসেরা রয়েছে। সেই করূবদের মধ্যে, হেবল যিহোবার প্রতি এমন ধরনের আনুগত্য ও বাধ্যতা দেখেছিলেন, যা তিনি তার নিজের পরিবারে খুঁজে পাননি। নিশ্চিতভাবেই, এই দূতেদের উদাহরণ তার বিশ্বাসকে শক্তিশালী করেছিল।
তাঁর সৃষ্টি, প্রতিজ্ঞাগুলো এবং তাঁর দাসদের উদাহরণগুলোর মাধ্যমে যিহোবা নিজের সম্বন্ধে যাকিছু প্রকাশ করেছেন, সেই সমস্তকিছুর ওপর ধ্যান করার দ্বারা হেবল দেখেছিলেন যে, তার বিশ্বাস আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তার উদাহরণ আমাদেরকে কিছু বলে, তাই নয় কি? এটা জানা বিশেষ করে অল্পবয়সিদের কাছে আশ্বাসজনক হতে পারে যে, তাদের পরিবারের সদস্যরা যা-ই করুক না কেন, তারা যিহোবা ঈশ্বরের প্রতি প্রকৃত বিশ্বাস গড়ে তুলতে পারে। আমাদের চারপাশের অপূর্ব সৃষ্টি এবং সম্পূর্ণ বাইবেল ও সেইসঙ্গে অনেক বিশ্বস্ত মানুষের উদাহরণ, আজকে আমাদেরকে বিশ্বাস গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভিত্তি জোগায়।
হেবলের বলিদান—যেকারণে উৎকৃষ্ট
যিহোবার প্রতি হেবলের বিশ্বাস যতই বাড়তে থাকে, ততই তিনি সেই বিশ্বাসকে কাজে প্রকাশ করার একটা উপায় খুঁজেছিলেন। তবে, একজন সাধারণ মানুষ নিখিলবিশ্বের সৃষ্টিকর্তাকে কীই-বা দিতে পারেন? ঈশ্বরের নিশ্চয়ই মানুষের কাছ থেকে কোনো উপহার ও সাহায্যের প্রয়োজন নেই। পরবর্তী সময়ে, হেবল এক গুরুত্বপূর্ণ সত্যকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন: তিনি যদি সঠিক মনোভাব নিয়ে, তার যা আছে তার সর্বোত্তমটা যিহোবাকে দেন, তাহলে তার প্রেমময় স্বর্গীয় পিতা খুশি হবেন।
তাই, হেবল তার পালের মধ্যে থেকে কয়েকটা মেষ উৎসর্গ করার জন্য আলাদা করেন। তিনি এর মধ্যে থেকে উৎকৃষ্ট, প্রথমজাত মেষ বেছে নেন এবং তাদের উত্তম অংশগুলো উৎসর্গ করেন। ইতিমধ্যে, কয়িনও উৎসর্গ করার জন্য তার শস্য থেকে কিছু আলাদা করে রাখার দ্বারা ঈশ্বরের আশীর্বাদ ও অনুগ্রহ লাভ করতে চেয়েছিল। কিন্তু তার মনোভাব হেবলের মতো ছিল না। দুই ভাই যখন তাদের উপহারগুলো উৎসর্গ করেছিল, তখনই পার্থক্যটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
আদমের দুই ছেলে তাদের উপহারগুলো উৎসর্গ করার জন্য হয়তো বেদি ও আগুন ব্যবহার করেছিল, সম্ভবত করূবদের দৃষ্টিগোচরে যারা সেই সময়ে পৃথিবীতে যিহোবার একমাত্র জীবন্ত প্রতিনিধি ছিল। যিহোবা সাড়া দিয়েছিলেন! আমরা পড়ি: “সদাপ্রভু হেবলকে ও তাহার উপহার গ্রাহ্য করিলেন।” (আদিপুস্তক ৪:৪) ঈশ্বর কীভাবে তা গ্রাহ্য করেছিলেন, বিবরণ তা জানায় না। কিন্তু, কেন তিনি হেবলকে গ্রাহ্য করেছিলেন?
শুধু কি উপহারের জন্য? এটা ঠিক যে, হেবল এক জীবন্ত, শ্বাসযুক্ত প্রাণীর অমূল্য রক্ত যা জীবনকে চিত্রিত করে, তা উৎসর্গ করেছিলেন। হেবল কি উপলব্ধি করেছিলেন যে, এই ধরনের এক বলিদান কতটা মূল্যবান? হেবলের সময় থেকে বহু শতাব্দী পর, ঈশ্বর এক নিখুঁত মেষকে বলি হিসেবে ব্যবহার করতে বলেছিলেন, যা তাঁর নিজ সিদ্ধ পুত্র অর্থাৎ ‘ঈশ্বরের মেষশাবকের’ বলিদানকে চিত্রিত করে, যাঁর নিষ্কলঙ্ক রক্ত পাতিত হবে। (যোহন ১:২৯; যাত্রাপুস্তক ১২:৫-৭) তবুও, নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, সেগুলোর অনেক কিছুই হেবলের অজানা বা তার বোধের অগম্য ছিল।
তবে, নিশ্চিতভাবে আমরা যা জানি, তা হল: হেবলের যা ছিল তার সর্বোত্তমটা তিনি উৎসর্গ করেছিলেন। যিহোবা শুধুমাত্র তার উপহারকেই নয় কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে তাকেও গ্রাহ্য করেছিলেন। যিহোবার প্রতি ভালোবাসা এবং তাঁর ওপর প্রকৃত বিশ্বাসের দ্বারা পরিচালিত হয়ে হেবল কাজ করেছিলেন।
কয়িনের ক্ষেত্রে বিষয়টা আলাদা ছিল। যিহোবা “কয়িনকে ও তাহার উপহার গ্রাহ্য করিলেন না।” (আদিপুস্তক ৪:৫) কয়িনের উপহারটা যে-ত্রুটিযুক্ত ছিল এমন নয়; পরবর্তী সময়ে, ঈশ্বরের ব্যবস্থা ভূমিতে উৎপন্ন দ্রব্যাদি উৎসর্গ করার অনুমতি দিয়েছিল। (লেবীয় পুস্তক ৬:১৪, ১৫) কিন্তু বাইবেল কয়িন সম্বন্ধে বলে যে, ‘তাহার নিজের কার্য্য মন্দ ছিল।’ (১ যোহন ৩:১২) আজকের দিনের অনেকের মতো, স্পষ্টতই কয়িন ভেবেছিল যে, ঈশ্বরের প্রতি লোক দেখানো ভক্তিই যথেষ্ট। যিহোবার প্রতি তার প্রকৃত বিশ্বাস অথবা প্রেমের অভাব, শীঘ্রই তার কাজে প্রকাশ পেয়েছিল।
কয়িন যখন দেখেছিল যে, যিহোবা তাকে গ্রাহ্য করেননি, তখন সে কি হেবলের উদাহরণ থেকে কিছু শেখার চেষ্টা করেছিল? না। সে তার ভাইয়ের ওপর রাগে ফেটে পড়েছিল। কয়িনের মনে কী ঘটছে, তা যিহোবা লক্ষ করেছিলেন এবং ধৈর্য ধরে তার সঙ্গে যুক্তি করেছিলেন। তিনি কয়িনকে সতর্ক করেছিলেন যে, তার কাজ তাকে গুরুতর পাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে এবং কয়িন যদি তার পথ পরিবর্তন করে, তাহলে তাকে “গ্রাহ্য” করার আশাও প্রদান করেছিলেন।—আদিপুস্তক ৪:৬, ৭.
কয়িন ঈশ্বরের সতর্কবাণীকে উপেক্ষা করেছিল। এর পরিবর্তে, সে তার বিশ্বস্ত ছোটো ভাইকে মাঠে তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। সেখানে কয়িন হেবলকে আক্রমণ করে তাকে হত্যা করেছিল। (আদিপুস্তক ৪:৮) এক অর্থে, হেবল ধর্মীয় তাড়নার প্রথম শিকার, প্রথম শহিদ হয়ে উঠেছিলেন। তিনি মারা গিয়েছেন কিন্তু তার কাহিনী কখনোই শেষ হয়ে যায়নি।
রূপকভাবে বললে, হেবলের রক্ত প্রতিশোধের বা ন্যায়বিচারের জন্য যিহোবা ঈশ্বরের কাছে ক্রন্দন করছিল। আর দুষ্ট কয়িনকে তার অপরাধের জন্য শাস্তি দিয়ে ঈশ্বর ন্যায়বিচার করেছিলেন। (আদিপুস্তক ৪:৯-১২) আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে, হেবলের বিশ্বাসের বিবরণ আজও আমাদের সঙ্গে কথা বলে। সেই সময়কার মানুষের তুলনায়, তার জীবনকাল অনেক কম ছিল—সম্ভবত, একশো বছরের কাছাকাছি—কিন্তু হেবল এমনভাবে জীবনযাপন করেছিলেন যা ঈশ্বরকে খুশি করে। তিনি এটা জেনে মারা গিয়েছিলেন যে, তার প্রতি তার স্বর্গীয় পিতা, যিহোবার ভালোবাসা ও অনুমোদন রয়েছে। (ইব্রীয় ১১:৪) তাই, আমরা এই আস্থা রাখতে পারি যে, যিহোবার অসীম স্মৃতিতে তিনি সুরক্ষিত, এক পার্থিব পরমদেশে জীবনের পুনরুত্থানের অপেক্ষায় রয়েছেন। (যোহন ৫:২৮, ২৯) আপনি কি সেখানে তার সঙ্গে দেখা করবেন? আপনি তা পারেন, যদি আপনি হেবলের বলা কথা শোনার ও তার উল্লেখযোগ্য বিশ্বাস অনুকরণ করার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হন। ▪ (w১৩-E ০১/০১)
[পাদটীকা]
a মূল ভাষায় ‘জগতের পত্তন’ অভিব্যক্তিটি বীজ বপন করার ধারণা দেয়, যেটা প্রজননকে ইঙ্গিত করে, তাই এটা প্রথম মানব সন্তানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু যিশু কেন কয়িন, যে প্রথম মানব সন্তান ছিল তাকে নয় কিন্তু হেবলকে ‘জগতের পত্তনের’ সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন? কয়িনের সিদ্ধান্ত ও কাজগুলো স্বেচ্ছায় যিহোবা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে করা বিদ্রোহ ছিল। তার বাবা-মার মতোই কয়িনও পুনরুত্থান ও মুক্তি পাওয়ার তালিকায় আসে না।
[১২ পৃষ্ঠার চিত্র]
[১৩ পৃষ্ঠার চিত্র]
হেবল তার জীবনকালে দেখেছিলেন যে, করূবরা ছিল যিহোবার বিশ্বস্ত ও বাধ্য দাস
[১৪ পৃষ্ঠার ব্লার্ব]
সৃষ্টির মধ্যে হেবল এক প্রেমময় সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাসের দৃঢ় ভিত্তি খুঁজে পেয়েছিলেন
[১৫ পৃষ্ঠার চিত্র]
হেবল বিশ্বাসের সঙ্গে তার বলি উৎসর্গ করেছিলেন; কিন্তু কয়িন তা করেননি